মো: আবুল হাসান:
ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট ক্যোঁতের পজিটিভিজমের সাথে অ্যারিস্টটলের অ্যাক্টিভ ফিলোসোফির ফিউশন ঘটিয়ে বেনেতো মুসোলিনি ও তার শিক্ষামন্ত্রী জেন্টিল জিহোভান্নি ১৯৩২ সালে ডক্ট্রিন অব ফ্যাসিজমের তত্ত্ব হাজির করেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে সহিংস ও যুদ্ধংদেহী ইচ্ছায় গড়ে তোলা কর্মীবাহিনীর সাথে করপোরেট শক্তি, কিছু আমলা ও সেনাবাহিনীর মদদে বেশির ভাগ মানুষের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের প্রতিভ‚রূপে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় আসীন থাকার আয়োজনই ফ্যাসিবাদ।
মুসোলিনি দাবি করেছিলেন, ফ্যাসিবাদের দলীয় কাঠামো, শিক্ষাপদ্ধতি এবং শৃঙ্খলা তখনই কেবল উপলব্ধি করা যাবে, যখন তার বাস্তবিক প্রকাশকে জীবনের স্বাভাবিক ঝোঁক বা প্রবণতার সাথে মিলিয়ে বিবেচনা করা যায়। তিনি আরো দাবি করেন, অন্যান্য পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ধারণার মতো ফ্যাসিবাদও একটি রাজনৈতিক কর্ম ও চিন্তা, যা ঐতিহাসিক শক্তির স্রোতধারায় প্রোথিত ও সেখান থেকে উৎসারিত হয়ে, এর অভ্যন্তরে থেকেই কাজ করে থাকে।
ফ্যাসিবাদ প্রচলিত সব ধর্মীয় আখ্যান ও রাজনৈতিক তত্ত্বগুলোকে খারিজ করে নতুন এক রাজনৈতিক ধর্ম ও আধ্যাত্মিক সময় দাবি করে, যেখানে রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে ব্যক্তির ইচ্ছা গৌণরূপ ধারণ করে। ব্যক্তি ততটুকুই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে যতটুকু পর্যন্ত রাষ্ট্রের ইচ্ছার সাথে এর সঙ্ঘাত তৈরি না করে। অনেকেই দাবি করেন, ফ্যাসিবাদ বাম রাজনীতির উপাদানগুলো গ্রহণের মাধ্যমে ডান রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। ফ্যাসিবাদী তত্ত্বে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থার স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে গণতন্ত্রের মোড়কে বাজারজাত হয়।
ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রাভ্যন্তরে চিরায়ত গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকির অজুহাতে কোনো সম্প্রদায়কে বেছে নিয়ে তাদের ধ্বংস অব্যাহত রাখে। কিন্তু সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্মূল করে দেয় না। ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি জার্মানি ইহুদি ও সোস্যালিস্টদের বেছে নিয়েছিল। যেমনটা সাদ্দাম হোসেন বেছে নিয়েছিলেন কুর্দিদের, একুশ শতকের ইউরোপ অভিবাসীদের, আমেরিকা ও ইউরোপ গত শতকে সমাজতন্ত্রীদের ও মুসলমানদের, তালেবান, লাদেন একই আদলে তৈরি। আমাদের দেশেও বর্তমানে ইসলামপন্থীদের দমাতে একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ জনগণের সামনে সোনালি অতীতের গল্প হাজির করে, জাতিকে সেই সোনালি দিনগুলোর মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। ১৯২৩ সালের এক বক্তৃতায় মুসোলিনি বলেন, ‘ফ্যাসিজম শ্রমিক ও শ্রমদাতাদের নিয়ে একটি বিরোধশূন্য সম্পর্ক গড়ে তুলে, উৎপন্ন দ্রব্যের সংখ্যা যতদূর সম্ভব বাড়াতে জাতির স্বার্থে প্রায়ই শ্রমিক শ্রেণী ব্যক্তিগত স্বার্থ বলি দিয়েছে। এর মাধ্যমে সিন্ডিক্যাটিজমের করপোরেট স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করে দেয়।
রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাসের গতিধারায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সমাধানের অজুহাতে প্রতিপক্ষ নির্মূলের বয়ান হাজির করে। মুসোলিনি বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর জাতিরাষ্ট্রকে তৈরি করার ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে বরং রাষ্ট্রই জাতিকে তৈরি করে, যেখানে প্রকৃত জীবনের চাহিদা ও জাতিগত ইচ্ছা ব্যক্তি তার নৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সপে দেয়। রাষ্ট্র কেবলমাত্র ব্যক্তি ইচ্ছাকে সীমাবদ্ধ করে শাসন করার কর্তৃত্বই নয়, বাস্তবিকভাবে প্রমাণগুলো আত্মস্থ করে উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে, যার সাইনবোর্ড সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও শাসকশ্রেণীর মহাকর্মযজ্ঞের ডামাডোলে পরিলক্ষিত।
অর্থনৈতিক চরম মন্দাবস্থায়ও মুসোলিনি ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করেছিলেন। শুনতে অবাক লাগলেও পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল প্রকল্পের মতো মেগা কাজগুলোও চিরায়ত এই চরিত্রের প্রকাশ বলে মনে হয়। মুসোলিনি সুচতুরভাবে আরো বলেন, যারা ফ্যাসিবাদের আধ্যাত্মিকতাকে সুবিধাবাদের বাইরে চিন্তা করতে পারেন না, তারা বুঝতে অক্ষম যে, ফ্যাসিবাদ কেবল একটা সরকার-পদ্ধতিই নয়, চিন্তার ধরনও বটে। তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নাকচ করে দেন এভাবে যে, ‘সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের সংখ্যাধিক্যে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র যা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে তেমন গণতন্ত্রের চেয়ে সেই গণতন্ত্রে তারা বিশ্বাস করেন, সংখ্যার তুলনায় জাতির প্রকৃত গুণকে প্রাধান্য দিয়ে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক দোষারোপে গণতন্ত্র দেশকে পিছিয়ে দেয়, পক্ষান্তরে ফ্যাসিবাদ দ্রুত এগিয়ে চলে বলে দাবি তার।
বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসে দেশকে পিছিয়ে দেবে, এমন কারণ দেখিয়ে নিরপেক্ষ ভোটের তুলনায় বর্তমান সরকারেরই ক্ষমতায় থাকা শ্রেয়তর বলে বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান এখন দেশে চলমান আছে। সুসংগঠিত, কেন্দ্রীভূত এবং কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রই হলো ফ্যাসিজম, এমন হাস্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক অপবয়ানও দেশে নিয়তই প্রতিধ্বনিত হয়।
শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ খোলা আছে বলে দাবি করেন মুসোলিনি এবং বলেন, এতে তারা ভীতও নন। শাসনক্ষমতা যদি পরিবর্তন হয়েও যায়, সে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অধিকার কেবল তাদেরই। কারণ তারাই কেবল জয়ের পথ বাতলে দেয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেন।
‘তিনিই পারেন, তিনিই পারবেন’ এমন বয়ান রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনকে পরোক্ষভাবে নাকচ করে দেয়। আমাদের সরকার শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে চান না, আদতে আগের রাতে ভোট হয়ে গেলে ভোটাররা ভোট দিতেই যাননি।
রাষ্ট্রীয় মদদে একটি উগ্র জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়াস ফ্যাসিবাদের অভ্যন্তরে লুকায়িত আছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে রাষ্ট্র অপরাধে উৎসাহিত করছে। খুন ও ধর্ষণকে, ফ্যাসিবাদী পুরুষোচিত আচরণ হিসেবে দেখছে রাষ্ট্র। এমন পুরুষরাই ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রাখতে দেখা গেছে।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও উদার নীতিবাদের ছায়াতলে টিকে থাকা ভালো গুণগুলোর নির্যাসে ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠেছে বলে দাবি মুসোলিনির। সে জন্য ফরাসি উদারনৈতিক চিন্তক রঁম্যারঁলা বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের মুখোশ একটি নয়, বহু। এর অঙ্গে সামরিক বেশ ও পরনে ধর্মযাজকের পোশাক। এটা কখনো পুঁজিবাদী, আবার কখনো সমাজতন্ত্রী। কিন্তু যে মুখোশই এর মধ্যে থাকুক না কেন, এটা উগ্র জাতীয়তাবাদী। এটা সব কিছুকে জাতির সাথে একীভূত করে জাতিকে একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রাধান্য স্বীকারে বাধ্য করে, যাতে সবকিছু সে শৃঙ্খলিত করতে পারে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে সবকিছুকে একীভূত করে। সেজন্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় রাষ্ট্র কোনোরকম ফাঁক রাখেনি। রাষ্ট্রকে উঁচু করার অর্থে ফ্যাসিবাদ সরকারকে উঁচুতে তুলে ধরে। ফ্যাসিবাদ প্রতিনিয়ত জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির কথা বলে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। উগ্রপন্থার আক্রমণের মতো নানা কল্পকাহিনী তৈরি করে আমলাতন্ত্র ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। সব মানুষকে ফ্যাসিস্ট দলে নাম লিখিয়েছিলেন মুসোলিনি। যেমনটা এ দেশেও ঘটেছিল। ফ্যাসিস্ট দলে নাম না লেখালে কারো চাকরি হতো না এবং বহু মানুষকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল নাম না লেখানোতে। সংবাদপত্রগুলোকে বাধ্য করা হয়েছিল ফ্যাসিস্টদের গুণকীর্তন করতে। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার তকমা লাগিয়ে গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যা করা হতো।
১৯৩৪ সালে বামপন্থী রাজনীতিবিদ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপ ঘুরে এসে ‘ফ্যাসিজম’ নামক বই লিখে শতাব্দীর অশনিসঙ্কেত দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জিও দিমিত্রভ তার থিসিসে বলেন, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, লগ্নিপুঁজির প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার ল্যাকুয়ার তার ‘ফ্যাসিজম; পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার’ বইয়ে বলেছেন, ‘একটি বৈশিষ্ট্য ফ্যাসিবাদকে অতীতের সব স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে আলাদা করেছে। ফ্যাসিবাদী শাসনে একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকে আর এই দলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের মাধ্যমে একচেটিয়া ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। এটা করতে গিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই ধরনের দলের নেতৃত্বে এমন একজন নেতা বা নেত্রী থাকেন যিনি দৃশ্যত সীমাহীন ক্ষমতাবান। তাকে তার অনুসারীরা দেব-দেবীর মতোই পূজা-অর্চনায় সিক্ত রাখে। তাদের এই আনুগত্য প্রায় ধর্মীয় ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই রাজনৈতিক দলটি শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয় বরং তাদের মতাদর্শিক বিশ্বাসকে বাকি সব নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করে তোলে। একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এই মতাদর্শিক বিশ্বাসকে তারা প্রতিনিয়ত প্রচার করতে থাকে।’