বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৪:০৮ পূর্বাহ্ন

‘পেশা’ মামলাবাজি টার্গেট অঢেল টাকা

‘পেশা’ মামলাবাজি টার্গেট অঢেল টাকা

স্বদেশ ডেস্ক;

কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা, কখনো বা সাংবাদিক, এমনকি সম্পাদকও। একবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বড় কর্মকর্তা, আরেকবার এমপি-মন্ত্রীর ‘কাছের মানুষ’। যখন যেখানে যেমন পরিচয়ে ফায়দা আসবে, তখন তেমন। প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসনের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবিও রয়েছে তার বিস্তর। এগুলো যে কারসাজির মাধ্যমে তৈরি, তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে পা রাখেন তার পাতা প্রতারণার ফাঁদে। পেশায় মামলাবাজ এ লোকের নাম আজিজুল হক পাটোয়ারী। অর্থের বিনিময়ে অন্যের পক্ষে মামলাবাজ হিসেবে ভাড়ায় খাটেন তিনি।

শুধু তা-ই নয়। এর উল্টোতেও আছেন। মামলায় ফেঁসে যাওয়া মানুষকে দায় থেকে মুক্ত করার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকাও নেন। এমনটা বলছেন ভুক্তভোগীরা। দেশের বিভিন্ন আদালতে-থানায় এ পর্যন্ত শতাধিক ভুয়া মামলা করেছেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। এবং সর্বশেষ সংবাদ, তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর সুবাদেই বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, খিলগাঁও থানায় ভুক্তভোগী এক নারী আজিজুল হক পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে মামলা করার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার আয়নাতলীর মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে ২০১৬ সালে পরিচয় হয় আজিজুল হক পাটোয়ারীর। পরিচয়ের সূত্র ধরে তার পাওনা টাকা উদ্ধারে সহযোগিতা করবেন এমন চুক্তিতে ৫ লাখ টাকা নেন তিনি। পরে তাতে ব্যর্থ হলে টাকা ফেরত চান মনোয়ারা। এ কারণে পড়েন আজিজুলের রোষানলে। ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নারী পাচারকারী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, দেহ ব্যবসায়ী ইত্যাদি নানা অভিযোগে মনোয়ারার বিরুদ্ধে একের পর এক পাঁচটি মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়েছেন আজিজুল। সবগুলোতেই পরবর্তীকালে তিনি খালাস পান।

মনোয়ারা বেগম আমাদের সময়কে বলেন, টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলে বেশ কয়েকবার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন আজিজুল। কিন্তু কাজ হয়নি। উল্টো আরও টাকা দাবি করতে থাকেন। টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে হুমকি-ধমকি দিতেন।

কেবল মনোয়ারাই নন, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষ আজিজুল হক পাটোয়ারীর এমন মিথ্যা মামলার জালে জেল খেটেছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমনকি মারাও গেছেন।

আজিজুল হক পাটোয়ারীর বাদী হয়ে করা অন্তত ২৪টি মামলার নথি পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তার করা মামলার প্রকৃত সংখ্যা শত পেরিয়ে গেছে।

আজিজুল হক পাটোয়ারীর মামলা ও অভিযোগগুলোর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনা প্রায় কাছাকাছি হলেও থানা/আসামি ভিন্ন। এমনই একটি মামলা হয় গত ২৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায়। অভিযোগ করা হয়, ফ্রেশ কোম্পানির একটি কাভার্ড ভ্যানের চালক ও ওই কোম্পানির নৈশপ্রহরীরা আজিজুল হক পাটোয়ারী এবং তার সহকর্মী সোহানকে মারধর ও জখম করে ক্যামেরা ও ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়েছেন। এতে তিনজনকে আসামি করা হয়, যার দুজনের নাম থাকলেও ঠিকানা বা পরিচয় অজ্ঞাত। এর পর ওই মামলায় চাঁদপুরের মাদ্রাসাশিক্ষক ইকবাল হোসেন এবং হোটেল ব্যবসায়ী ইমাম হোসেনকে ধরতে পুলিশ যায় বাসায়। তবে পরবর্তী সময়ে ঘটনা মিথ্যা বুঝতে পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এ বিষয়ে সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তৌফিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা মিথ্যা মামলা বুঝতে পেরে ইতোমধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি আদালতে।

ভুক্তভোগী মাদ্রাসাশিক্ষক ইকবাল হোসেন বলেন, আমি গণিতের শিক্ষক। আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১১টি মিথ্যা মামলা করেছেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। তার ছেলে আবু ইউসুফ পাটোয়ারী করেছেন আরও তিনটি মামলা। আর বিভিন্ন দপ্তরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে ৯২টি। তিনি বলেন, আমার জানা মতে অন্তত ২০ জন এ পর্যন্ত জেল খেটেছেন পাটোয়ারীর করা মিথ্যা মামলায়। অনেকে মান-ইজ্জতের ভয়ে টাকা দিয়ে তার সঙ্গে দফারফা করেছেন।

এই মাদ্রাসাশিক্ষক বলেন, তার করা মামলাগুলোর কারণে গত পাঁচ বছরে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। বিভিন্ন এনজিও আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। ১৫ লাখ টাকার বেশি দেনা। আজিজুল হক পাটোয়ারীর মামলায় আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে।

২০১৮ সালের ৪ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করেন আজিজুল। সৈকত পালসহ আসামি চারজন। একই অভিযোগে ২৩ দিন পর রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি মামলা করেন পাটোয়ারী। আসামি সেই সৈকত পাল। দুদিন পরই আবারও ছিনতাইয়ের শিকার হন বলে সৈকত পালের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় আরেকটি মামলা করেন আজিজুল।

ভুক্তভোগী সৈকত পাল আমাদের সময়কে জানান, পাটোয়ারী অর্থের বিনিময়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করত। এ নিয়ে আমি সংবাদ সম্মেলনও করি। মূলত ভালোবেসে বিয়ে করার পর থেকেই আমার ভোগান্তির শুরু। আমার শ্বশুর সুধীর সাহার হয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে ভাড়ায় এই মামলাগুলো করেছেন আজিজুল। আমি তাকে কোনো দিন নিজ চোখে দেখিনি। সবগুলো মামলা আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। মিথ্যা মামলা করায় আদালত ২১১ ধারায় বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে বলেছেন।

আরেকজন ভুক্তভোগী ইমান হোসেন পাটোয়ারী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে ২৫টি। আদালতে মামলা করা হয়েছে চারটি। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, একের পর এক মামলা আর অভিযোগ। আমি মূলত হোটেল ব্যবসায়ী। কিন্তু মামলার জালে আমার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আমার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার মামলাও করেছিল। হোটেলে ইয়াবা রেখে সে পুলিশকে খবর দিয়ে আমাকে আটক করায়। পরে প্রমাণিত হয় সব ভুয়া। তিনি বলেন, এলাকায় অনেকের নামেই মামলা করেছেন পাটোয়ারী। সবাই টাকার বিনিময়ে পরে দফারফা করেন। অনেকে ভুগতে ভুগতে মারাও গেছেন। একজন তো গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনা ও থানা ভিন্ন হলেও আজিজুলের করা মামলাগুলোয় আসামি হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ। তার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক যুগ ধরেই এলাকায় পেশাদার প্রতারক, মামলাবাজ ও জালিয়াত হিসেবে পরিচিত আজিজুল। কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা, কখনো সাংবাদিক, কখনো তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, কখনো হকার্স লীগ লিমিটেডের পরিচালক পরিচয় দিয়ে থাকেন। আজিজুল তার এই অপকর্মে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন দুটি নামসর্বস্ব পত্রিকাকে।

আজিজুল হক পাটোয়ারী গ্রেপ্তার হওয়ার পরও অনেক ভুক্তভোগী গণমাধ্যমে মুখ খুলতে নারাজ। তাদের শঙ্কা, জামিনে বেরিয়ে এসে আজিজুল তাদের আরও বেশি হয়রানি করবে। আজিজুলের বাদী হয়ে করা একটি মিথ্যা মামলার আসামি মনিরুল ইসলাম তফাদারের ছেলে মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমার ও আমার বাবার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছিল। বাবা এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। আদালত আমাদের এসব মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877