স্বদেশ ডেস্ক:
স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। আজ মঙ্গলবার তৃতীয় জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘তৃতীয় জাতীয় ভোটার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “বয়স যদি আঠারো হয়, ভোটার হতে দেরি নয়”। আমার কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ বলে মনে হয়। যিনি ১৮ বছরে সদ্য পদার্পণ করলেন, তিনি দেশের একজন পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। স্বভাবতই দেশ সম্পর্কে আগ্রহ, উপলব্ধি ও উৎসাহ তার মনে নতুনভাবে রেখাপাত করবে। ভোটার হওয়ার মাধ্যমে তিনি যে স্মার্ট কার্ডটি পাবেন, তা জীবনব্যাপী তার আত্মপরিচয়ের স্মারক। এ জন্য আজ নতুন ভোটারদের সকলকে অভিনন্দন জানাই। ভোটার হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।’
ইসির এ সদস্য বলেন, ‘সংবিধানে বলা হয়েছে— “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” ভোট প্রদান করে একজন ভোটারের এই দায়িত্ব পালন সাংবিধানিক অধিকার। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, “কার্যকর অংশগ্রহণ” বলতে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যোগ্য জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি নিজের বিবেকবোধের দ্বারা উদ্দীপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, এমনকি গোষ্ঠীগত লাভালাভের বৃত্ত থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, ‘একথা ধ্রুব সত্য যে, নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রে উত্তরণের একমাত্র পথ। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য না হলে ক্ষমতার হস্তান্তর স্বাভাবিক হতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তির নৈরাশ্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় আশঙ্কা রয়েছে। নৈরাজ্যপ্রবণতা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপদানের জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারলে আমরা গণতন্ত্র অস্তাচলে পাঠানোর দায়ে অভিযুক্ত হবো। বর্তমানে আমরা দেশব্যাপী পৌরসভা নির্বাচনের প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি। আগামী এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় নির্বাচনগুলোর গতিপ্রকৃতি দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের যে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” ও ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। এককেন্দ্রীয় নির্বাচনে স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই, নির্বাচনে মনোনয়নলাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হলেও অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দুর্ঘটনা মিলে এক ধরনের অবিছিন্নতা তৈরি হয়, যা নির্বাচনের অনুসঙ্গ হিসেবে রূপ লাভ করে।’
রাউজানের নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে। বিগত ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সেখানে মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে রাউজান থেকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও তখন তুলে নেওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে উপজেলা নির্বাচনেও ঠিক এভাবে রাউজানে সকলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এটা “নির্বাচন” না বলে “মনোনয়ন” বলাই সম্ভবত অধিকতর সঙ্গত। সারাদেশে যদি এই মডেলে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তাহলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন।’
ইভিএম ভোটের বিষয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘একসময়ে আমি বিভিন্ন কারণে ইভিএম বা ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরোধী ছিলাম। বিশেষভাবে কোনো প্রস্তুতি ব্যতিরেকে ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি করেছি। বর্তমানে প্রধানত দু’টি কারণে আমি ইভিএমে ভোটগ্রহণে আগ্রহী। প্রথমত, ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট কাস্ট হওয়ার বিড়ম্বনা থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২১৩টি কেন্দ্রের ফলাফলে আমরা যা দেখেছি। তবে ইভিএমে ভোট হলে ভোটারের উপস্থিতি ও ভোটের পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। বিগত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোটের শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ ও ২৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা সাড়ে ২২ ভাগ মাত্র। এত কম ভোটে আমরা রাজধানী ঢাকার দুজন ও চট্টগ্রামের একজন নগরপিতাকে নির্বাচিত করেছি, যার নজির নিতান্ত বিরল।’
‘ইভিএম ব্যবহার করে আমরা সর্বত্র ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছি, এমন দাবি আমি অন্তত করি না। কিন্তু, ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিরসন করার উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। নির্বাচন বিষয়ক অনিয়ম ও অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে না নেওয়ায় আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারি। তবে, ভবিষ্যতে ব্যালট ও ইভিএম— উভয় পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, একই নির্বাচনে দুইটি পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ভোটপ্রদানের শতকরা হারের অনেক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের অর্থ ভোটগ্রহণের ফলাফলে বিভেদ সৃষ্টি। ভোটগ্রহণে এ ধরনের বৈষম্য কাম্য নয়।’
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। আজও এই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
‘জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপন একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীন ভোটারদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি এই দিবসটিকে গৌরবান্বিত করেছে। আমি নতুন ভোটারদের আবারও অভিনন্দন জানাই’, যোগ করেন তিনি।