স্বদেশ ডেস্ক: ধান-নদী-খালের বরিশাল বিএনপির দুর্গ বলে জনশ্রুতি আছে। অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের পরিসংখ্যানও দিচ্ছে সেই তথ্য। যার ফলে আহসান হাবিব কামালের মতো ‘হঠাৎ নেতা’ও বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সেই দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো! বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন চরম হতাশায় সময় পার করছে। এর কারণ হিসেবে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা দুটি কারণের কথা বলছে। এর একটি মজিবর রহমান সরোয়ারের একক আধিপত্য। অন্য কারণ হলো, বিএনপির দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা।
যদিও মজিবর রহমান সরোয়ার বলছেন, সরকারের দমন-পীড়ন ও মানুষের ভোটাধিকার হরণের কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে একধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। যারা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ফলে অনেক নেতাকর্মী দলবিমুখ হয়ে পড়েছে।
তবে মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের ভাষ্য, মহানগর বিএনপির রাজনীতি সরোয়ার তাঁর মুঠোয় রেখেছেন। সরিয়েছেন যোগ্যদের। কাছে টানছেন অযোগ্যদের। ক্ষেত্রবিশেষে অনুসারীদের দিয়ে দল চালাচ্ছেন। এ কারণে নির্যাতিতদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে অভিমান করেই দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত রেখেছেন। অন্যদিকে বিএনপিতে আছেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী আর মেজর হাফিজ। তাঁরা দুজনই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। দলকে সুসংগঠিত করার জন্য তোফায়েল-আমুদের মতো তাঁরা দক্ষ নন। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপি সব সময় সাংগঠনিকভাবে অগোছালো ছিল। তবে কর্মী আর সমর্থকদের কারণে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে ছিল বিএনপি। তা ছাড়া সেলিমা রহমান আর জয়নুল আবেদীন শুধু ভোটের রাজনীতি করেন। দক্ষিণাঞ্চলের বিএনপিকে সংগঠিত করার চেষ্টা তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি।
বিএনপির অনেকেই মনে করে, মাঝ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে মজিবর রহমান সরোয়ারকে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে বরিশালের মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। শহর আর জাতীয় পর্যায়ের দুটি পদে থেকেও সরোয়ার শহরের রাজনীতিই করছেন। গেল নির্বাচনে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বরিশাল সদর আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। যদি আলালকে মনোনয়ন দেওয়া হতো, তাহলে বরিশালের যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা থেকে অনেকটাই উত্তরণ হতো। কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহির উদ্দীন স্বপনও ভোটের রাজনীতি করেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁকে দেখা যায় না।
কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহির উদ্দীন স্বপন বলেন, ‘আমার শুরুটাই জাতীয় রাজনীতির হাত ধরে। নির্বাচনী এলাকা ছাড়া অন্য স্থানের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ বিএনপির মতো এত বড় একটি সংগঠনের জন্য শীর্ষ পর্যায়ের কাজগুলো আমাকে করতে হয়। সে কারণে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে সময় দিতে পারি না।’
এক নেতা এক পদে, কিন্তু আপনি এখনো দুই পদে আছেন—এ প্রশ্নের জবাবে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘মহানগরের সভাপতি পদ না ছাড়ার কারণ দলীয় চেয়ারপারসনের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছি। তা ছাড়া সভাপতির দায়িত্ব দেওয়ার মতো কাউকে দল এখন পাচ্ছে না।’ নেতাদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে সরোয়ার বলেন, ‘আমি কোনো পছন্দের নেতাদের নিয়ে কমিটি করিনি। উন্মুক্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে। গত সিটি নির্বাচনে মহানগর বিএনপির অনেক নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ সরকারি দলের সঙ্গে যোগাযোগও রেখেছেন। তার পরও নির্বাচিত হতে না পেরে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।’
মহানগরে সরোয়ারই সব : মজিবর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন। আর মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে আছেন। ২০১৩ সালে ১৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে কামরুল আহসান শাহীন ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন জিয়া উদ্দিন সিকদার। তিনি ওই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। সাবেক-বর্তমান দুজনই সরোয়ারের ‘পকেটের লোক’। মহানগর বিএনপি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো বিরোধ না থাকলেও শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের নেতারা দলে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। জিয়া উদ্দিন সিকদারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করায় নিষ্ক্রিয়তার সৃষ্টি হয়েছে বলে দলের অনেকে মনে করে।
১৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে সহসভাপতির রয়েছেন ১১ জন। দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেন হাতে গোনা দুই-তিনজন। যুগ্ম সম্পাদকের মধ্যে সৈয়দ আকবর নিয়মিত দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন। অপরজন মীর জাহিদুল কবির দলীয় কার্যক্রমে শেষ কবে অংশ নিয়েছেন—তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। সহসম্পাদকের মধ্যে শুধু আনোয়ারুল হক তারিন দলে সক্রিয়। অন্য দুজন জামাল হোসেন নোমান ও আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম দলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদক আলতাফ মাহমুদ সিকদার দলের কোনো কর্মসূচিতে আসেন না। প্রচার সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহীন দলীয় কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।
মহানগরের সহসম্পাদক আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম বলেন, ‘২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আমার বিরুদ্ধে সরোয়ার প্রার্থী দিয়েছিলেন। সেই থেকেই সরোয়ারের নেতৃত্বে রাজনীতি করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছি। তা ছাড়া তাঁর (সরোয়ার) নেতৃত্ব আমার ভালো লাগে না। কারণ তিনি অযোগ্য লোকদের কাছে টানেন। তাদের দিয়ে দল চালান। আমাদের মূল্যায়ন করেন না।’
ছাত্রদলের রাজনীতি করে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান টিপু। ছিলেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়কের দায়িত্বে। তিনি বলেন, ‘মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আহসান হাবিব কামালের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় আমাকে মহানগর কমিটিতে রাখা হয়নি। শুধু আমাকেই নয়, আমার মতো অনেক নেতাকে প্রতিপক্ষ মনে করে মজিবর রহমান সরোয়ার কমিটিতে ঠাঁই দেননি।’
জেলাও সরোয়ারের হাত : সভাপতি পদ থেকে আহসান হাবিব কামালকে বাদ দিয়ে ২০১৩ সালের নভেম্বরে বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটিতে এবায়েদুল হক চানকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহীনকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঘোষিত ওই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সদ্যসাবেক হওয়া বিলকিস জাহান শিরিনকে দেওয়া হয়েছে সহসভাপতির পদ। এ ছাড়া সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান, শারফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু, অ্যাড. মাজিবুর রহমান নান্টু ও বাবুল চৌধুরীকে সহসভাপতি করা হয়েছে।
সভাপতি চান এবং সরোয়ারের অনুসারী সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীন পৃথকভাবে দুটি কমিটি কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনোটি অনুমোদন পায়নি। সরোয়ার-চানের দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা অংশ নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, ‘প্রস্তাবিত কমিটিতে আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছিল। নতুন কমিটি না করায় নেতাকর্মীরা এখন কর্মসূচিতে অংশ নিতে চাচ্ছে না। কারণ এ সময় কমিটি হলে বঞ্চিতরা জায়গা পেত।’
এবায়দুল হক চান বলেন, ‘বেশ কয়েকটি ইউনিট কমিটি গঠন করেছি। কিন্তু বরিশাল সদর উপজেলা ও বাকেরগঞ্জ কমিটি গঠন নিয়ে সরোয়ার বিরোধিতা করছেন। শুধু তাই নয়, সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মারা যাওয়ার পর ওই কমিটির সহসভাপতিকে অবৈধভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। সরোয়ারের এই অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের কারণে জেলা কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না।’
বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ইউনিট কমিটিগুলো গঠনের জন্য নতুন করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। দলের প্রধান লক্ষ্য—চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্যে ১৮ জুলাই বরিশাল বিভাগের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
যুবদল-ছাত্রদলও সরোয়ারের অনুসারী : আখতারুজ্জামান শামীমকে সভাপতি ও মাসুদ হাসান মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের বরিশাল মহানগর যুবদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটির মধ্যে একমাত্র সভাপতি আখতারুজ্জামান শামীম ছাড়া আর সবাই ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী। সেই সূত্র ধরেই বরিশাল মহানগর যুবদলের ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গত বছরের নভেম্বরে কেন্দ্র অনুমোদন দেয়। যে কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও সরোয়ার অনুসারীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। ফলে মহানগর যুবদলের কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না।
এদিকে রেজাউল করিম রনিকে সভাপতি এবং হুমায়ুন কবিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট মহানগর ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নগর ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। মহানগর ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি মহানগরের কোনো কলেজে ছাত্রদলের কমিটি নেই। যাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই বয়স নেই। কেউ কেউ বিবাহিত। কারো ঘরে সন্তানও আছে।