স্বদেশ ডেস্ক: ১৮৯৮ সালে রাজ্য নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার তৎকালীন সবচেয়ে সমুদ্ধ শহর উইলমিংটনে হামলা চালায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। সেদিন তারা কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে, তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, একটি নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয় তারা। ইতিহাসবিদরা এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একমাত্র অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অভ্যুত্থানের নেতারা হামলার দিনই জোরপূর্বকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রাজ্যটির কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দাদের ভোট দেওয়াসহ অন্য নাগরিক অধিকার নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করেন। আর এ সবকিছুর জন্য দায়মুক্তিও পেয়ে যান তারা।
এ মাসের শুরুর দিকে মার্কিন ক্যাপিটলে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের হামলার পর উইলমিংটনে হামলার ঘটনাটি আলোচনায় উঠে এসেছে।
১৮৬৫ সালে উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়নিস্ট ও দক্ষিণাঞ্চলীয় কনফেডারেসি রাজ্যগুলোর মাঝে সংগঠিত মার্কিন গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন দেশে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ মার্কিন সরকার। ওয়াশিংটনের আইনপ্রণেতারা দাসদের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার দিয়ে বেশ কয়েকটি আইন পাস করেন। আইনগুলো প্রণয়নে মোতায়েন করেন সেনাবাহিনী। কিন্তু অনেক দক্ষিণী এসব আইনের বিরোধী ছিলেন। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার বহু পদক্ষেপের বিরুদ্ধে চেষ্টা চালিয়ে যায় তারা।
উইলমিংটন তৎকালীন সময়ে বেশ বড় ও সমৃদ্ধ একটি বন্দর ছিল। সেখানে মধ্যবিত্ত ও সফল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রভাব বাড়ছিল। তবে তারাও নিয়মিত হারেই নানা কুসংস্কার ও বৈষম্যতার শিকার হতেন। অনেক ব্যাংক কৃষ্ণাঙ্গদের ঋণ দিতে চাইতো না বা দিলেও চড়া সুদ চাপিয়ে দিতো। কিন্তু গৃহযুদ্ধের ৩০ বছরের মধ্যে সাবেক কনফেডারেট রাজ্যগুলোয় ধীরে ধীরে ব্যবসা, বাড়ি গড়ে তুলছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। এর মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনার উইলমিংটন ছিল অন্যতম। প্রচলিত আছে, পুরো দেশের মধ্যে একমাত্র সেখানেই কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন একটি পত্রিকা- উইলমিংটন ডেইলি রেকর্ড- চালু ছিল।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক গ্লেন্ডা গিলমোর বলেন, আফ্রিকান আমেরিকানরা ব্যাপক সফল হয়ে উঠছিলেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিল, তাদের স্বাক্ষরতার হার বাড়ছিল, তাদের সম্পত্তির পরিমাণ বাড়ছিল।
ক্যারোলাইনায় তাদের সফলতা কেবল সামাজিকভাবে নয়, রাজনীতিকভাবেও বাড়তে থাকে। ১৮৯০ এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে রাজনৈতিক জোট তৈরি হয়। এ জোট ‘ফিউশনিস্ট’ হিসেবে পরিচিত ছিল। জোটটি আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, ঋণমুক্তি ও সমঅধিকার নিয়ে কাজ করতো। ১৮৯৬ সালে তার রাজ্যের প্রত্যেক সরকারি কার্যালয়ে জয়ী হয়, গভর্নরের কার্যালয়সহ। ১৮৯৮ সালে ফিউশনিস্ট রাজনীতিবিদরা উইলমিংটন শহরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জয়ী হয়।
এ জয়ের পরই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয় তারা। তাদের বিরোধীদের মধ্যে ছিল ডেমোক্রেট পার্টিও। বর্তমানের তুলনায় তৎকালীন সময়ে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান পার্টির অবস্থান ছিল অনেকটাই ভিন্ন। আব্রাহাম লিংকন নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান পার্টি তখন গৃহযুদ্ধের পর কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল। অন্যদিকে ডেমোক্রেট পার্টি ছিল এ পরিবর্তনের বিরোধী। দলটি প্রকাশ্যে বর্ণবাদী পৃথকীকরণ ও রাজ্য ভিত্তিতে অধিকার জোরালো করার দাবি জানিয়েছিল।
নর্থ ক্যারোলিনার আর্কাইভিস্ট ও উইলমিংটন বিদ্রোহ নিয়ে লেখা বইয়ের ‘এ ডে অব ব্লড’-এর লেখক লিরে আমফ্লিট বলেন, ১৮৯৮ সালের ডেমোক্রেট পার্টিকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দল হিসেবে ভাবুন।
এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ডেমোক্রেটরা আগ থেকেই আশঙ্কা করেছিল, ফিউশনিস্টরা ১৮৯৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হবে। তারা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ধারণাকে ভিত্তি করে উন্মুক্তভাবে প্রচারণা চালানো শুরু করে। ফিউশনিস্টদের পরাজিত করতে নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। আমফ্লিটের মতে, তারা ১৯৮৯ এর নভেম্বরের নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের জয় নিশ্চিত করতে সমন্বিতভাবে পত্রিকা, বক্তৃতাদান ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের নানা কৌশলসহ সবকিছুই ব্যবহার করেছিল।
‘রেড শার্ট’ নামে পরিচিত শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়ারা ঘোড়ায় চড়ে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের উপর হামলা চালিয়েছিল। একপর্যায়ে নিজেদের রক্ষা করতে উইলমিংটনের জনগণ অস্ত্র কেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বিক্রেতারা তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্টো যারা অস্ত্র কিনতে চেয়েছিল তাদের নাম লিখে রাখে।
এদিকে, পত্রিকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, শ্বেতাঙ্গ নারীদের শয্যাসঙ্গী করতে নির্বাচনে জয়ী হতে চায় কৃষ্ণাঙ্গরা। তাদের বিরুদ্ধে ‘ধর্ষণ মহামারী’র ভুয়া প্রচারণা চালানো হয়। এসব ভুয়া খবরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একদিন সম্পাদকীয় লিখেন উইলমিংটন ডেইলি রেকর্ডের মালিক ও সম্পাদক আলেক্সান্ডার ম্যানলি। তার এ সম্পাদকীয় ডেমোক্রেটদের আরো ক্ষেপিয়ে তোলে। ম্যানলিকে টার্গেট করে শুরু হয় প্রচারণা।
নির্বাচনের ঠিক আগের দিন ডেমোক্রেট নেতা আলফ্রেড মুর ওয়াডেল দলের কর্মীদের কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতে নির্দেশ দেন। বলেন, ‘আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করুন। তাদের কেন্দ্র থেকে সরে যেতে বলুন। না যেতে চাইলে খুন করুণ, গুলি করুন। বন্দুক ব্যবহার করে হলেও আগামীকাল আমাদের জিততে হবে।’
রাজ্য নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয়ী হয় ডেমোক্রেটরা। কিন্তু উইলমিংটনে ক্ষমতা ধরে রাখে ফিউশনিস্টরা। নির্বাচনের দু’দিন পর ওয়াডেল ও শত শত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বন্দুক নিয়ে শহরটিতে যায়। উইলমিংটন ডেইলি রেকর্ডের ভবনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এরপর পুরো শহরজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে, তাদের ব্যবসা ধ্বংস করে দেয়। বেলা বাড়তে থাকলে হামলায় যোগ দেয় আরো শ্বেতাঙ্গবাদীরা। বাড়তে থাকে নৃশংসতা। ওয়াডেল ও তার সেনারা সিটি হলে ঢুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ফিউশনিস্ট সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেদিন বিকেলেই ওয়াডেলকে শহরটির মেয়র ঘোষণা করা হয়।
দুই বছরের মধ্যে নর্থ ক্যারোলিনার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বর্ণবাদী পৃথকীকরণ বিষয়ক আইন পাস করে। স্বাক্ষরতার পরীক্ষা ও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের ওপর শুল্ক চাপিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটদানের অধিকার কার্যকরভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৯৬ সালে যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার, সেখানে ১৯০২ সালে তা দাঁড়ায় ৬ হাজারে।
এখানেই অবশ্য শ্বেতাঙ্গবাদীদের চেষ্টা থেমে যায়নি। হামলার ঘটনাটি ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্ম এ হামলার ব্যাপারে বড় পরিসরে অজানাই থেকে যায়। কেউই ঘটনাটি নিয়ে কথা বলতো না। প্রায় এক শতাব্দী পরে গত শতকের নবব্বইয়ের দশকে শহরটি ঘৃণ্য এ অতীত নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হামলার ১০০ বছর স্মরণ করার নির্দেশ দেয়। দুই বছর বাদে ঘটনার সত্যতা প্রতিষ্ঠায় কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ওই ঘটনা স্মরণে স্থাপন করা হয় মন্যুমেন্ট ও মেমোরিয়াল পার্ক।
কিন্তু আদতে, উইলমিংটন হামলার ঘটনা চাপা দেয়া হয়নি। বরং তা প্রকাশেরই চেষ্টা করা হয়েছে। হামলাটিকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। হামলাকারীদের নাম স্থান পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও সরকারি ভবনের ফলকগুলোয়। অনেকে হামলায় অংশগ্রহণ করার কথা গৌরব নিয়ে প্রকাশ করতেন। তাদের মধ্যে ডেমোক্রেট পার্টির নেতাকর্মীরাও ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস বইগুলোয় উইলমিংটনে হামলাটির বিকৃত এক রূপ স্থান পায়। লেখা হয়, আদতে এই হামলা শুরু করেছিল কৃষ্ণাঙ্গরা ও এটা থামিয়েছিল শ্বেতাঙ্গরা।
১৯০১ সালে উইলমিংটনে হামলার অন্যতম সংগঠক চার্লস আয়কক নর্থ পরে ক্যারোলাইনার গভর্নর নির্বাচিত হন। মার্কিন ক্যাপিটলে পরবর্তীতে তার একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়, যা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।