রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা

বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা

স্বদেশ ডেস্ক: বৃটেন এবং ইইউর মধ্যে ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য নিয়ে কঠোর আলোচনা অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে। ১০মাস ধরে ব্যাপক দর কষাকষি ও বাক বিতণ্ডার পর আজ বহুল আলোচিত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ঐক্যমতে ঘোষণা হয়েছে। অনেক বাধা পেরিয়ে কার্যকর হচ্ছে এটি। ২০১৬ সালের গণভোটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারি ইইউর সঙ্গে বৃটেনের দীর্ঘ ৪৫ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটছে। এই চুক্তির ফলে অতীত সম্পর্কের অনেক কিছুই হয়ত বদলে যাবে, কিন্তু বন্ধুত্ব টিকে থাকবে। অংশীজন এবং মিত্র হিসেবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন আজ ও গতকাল বিস্তর কথা বলেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের শেষ ঘোষণার মুহুর্তের জন্য সকলেই ছিলেন অপেক্ষমান। অবশেষে দুপর গড়িয়ে এখন লন্ডন সময় বিকেল ৩টায় ঐতিহাসিক ঘোষণা আসে।

চুক্তির সময়কাল সমাপ্তির সাত দিন আগে এই খবরে অবসান ঘটেছে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার।

এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বরিস জনসন বলেছেন, জনসাধারণকে ২০১৬ সালের গণভোটের সময় এবং গত বছর সাধারণ নির্বাচনের সময় যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা এই চুক্তির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। আমরা আমাদের অর্থ, সীমানা, আইন, বাণিজ্য এবং আমাদের মাছ ধরার জলের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিয়েছি। এই চুক্তি যুক্তরাজ্যের প্রতিটি অংশে পরিবার এবং ব্যবসায়ের জন্য দুর্দান্ত খবর। আমরা শূন্য শুল্ক এবং শূন্য কোটার ভিত্তিতে প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। বরিস জনসন আরো বলেন, এই চুক্তি আমাদের ইউরোপীয় বন্ধুদের সাথে রফতানিকারকদের আরও বেশি ব্যবসা করার অনুমতি দেবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো আমরা আমাদের জলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সহ একটি স্বাধীন অবস্থান নিশ্চিত করেছি।

অপর প্রেস ব্রিফিংয়ে মিসেস ভন ডার লেন বলেছেন, আমরা শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তি করতে পেরেছি। এটি একটি দীর্ঘ এবং ঘুরে বেড়ানো রাস্তা ছিল। তবে যথেষ্ট শ্রম দিয়ে উভয় পক্ষের জন্য আমরা ন্যায্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমতায় পৌছেছি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্রেক্সিট বিষয়ে সমন্বয়ক মিশেল বার্নিয়ার আলোচনায় সার্বিক সহায়তার জন্য সকল রাজনীতিবিদ, নাগরিক এবং এমনকি সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

বৃটেনের প্রধান আলোচক লর্ড ফ্রস্ট বলেছেন, আমি খুব সন্তুষ্ট এবং গর্বিত যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আজকের দুর্দান্ত চুক্তিটি নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যের দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। উভয় পক্ষই রেকর্ড সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম ও বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তি অর্জনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে সফল হয়েছি।

ইউকে এবং ইইউ আলোচক দল চুক্তির বিশদ চূড়ান্ত করতে সারারাত কাজ করেছেন। তারা ডাউনিং স্ট্রিট এবং ইইউ সদস্য দেশগুলির প্রতি সন্তোষজনক একটি সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। ইইউ সদস্য রাষ্ট্র সমূহের প্রতিনিধিত্বকারী কূটনীতিকরা ইতিমধ্যে প্রায় ২ হাজার পৃষ্ঠার আইনগত বক্তব্য বিশ্লেষনের পর তাতে প্রাথমিক ভাবে সম্মত হয়েছেন।

আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী সাইমন কোভনি আজ বলেছেন, আশা করি এই ক্রিসমাসে ব্রেক্সিট আমাদের সুসংবাদ সরবরাহ করবে। একটি সুত্র বলেছে, ইউকে মাছ ধরাতে বেশ ভাল চুক্তি করেছে। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই বছরে ১৩০,০০০ টন মাছের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে।

প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ব্রেক্সিট শিরোনামে আধিপত্য বিস্তার করা সংবাদের সাথে বৃটেনের মানুষ আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফিনিস লাইন‘ বা সমাপ্তি রেখা টানছেন। তাদের মতে, ক্রিসমাসের কয়েক ঘন্টা আগে সীলমোহর করা এই চুক্তিটি আমাদেরকে শুল্ক বা কোটা ছাড়াই ইইউর সাথে অবাধে বাণিজ্য করার অনুমতি দেবে এবং ব্রেক্সিটের প্রায় সাড়ে চার বছরের তিক্ততার অবসান ঘটাবে।

বিচ্ছেদও কখনো প্রত্যাশিত হয়, ব্রেক্সিট তার উদাহরণ। এই বিচ্ছেদ ঘিরে কয়েক বছর ধরে তুলকালাম কান্ড ঘটেছে ইউকে সহ গোটা ইউরোপ জুড়ে। কাঙ্ক্ষিত ব্রেক্সিট চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হওয়ায় পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। উত্থান ঘটে ব্রেক্সিটপন্থী নেতা বরিস জনসনের। অবশেষে ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার বৃটেনের সময় রাত ১১টায় ঘটে যায় আলোচিত বিচ্ছেদ। উভয়পক্ষ বিচ্ছেদ কার্যকরের চুক্তিতে (ব্রেক্সিট চুক্তি) আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাক্ষর করেন।

চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বাণিজ্যসহ বিদ্যমান অন্যান্য সম্পর্ক বজায় থাকে। চুক্তির পাশাপাশি এক যৌথ রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রে বাণিজ্য, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। চুক্তিতে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ইইউ নাগরিক এবং ইইউভুক্ত দেশে অবস্থানরত বৃটিশ নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা, আয়ারল্যান্ড সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মতো জটিল বিষয়গুলোতে একমত হন উভয় পক্ষ।

ইইউর শীর্ষ দুই নেতা ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল তখন ব্রেক্সিট চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ব্রাসেলসের ইউরোপা ভবনে বহুল আলোচিত এই বিচ্ছেদ চুক্তি সম্পন্ন হয়। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাংবিধান বিষয়ক কমিটি ৬০০ পৃষ্ঠার এই চুক্তিটি অনুমোদন করে। চুক্তি সম্পাদনে ইইউর পক্ষে এই সমঝোতায় নেতৃত্ব দেন সফল কূটনীতিক মিশেল বার্নিয়ার।

২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে বৃটেনের মানুষ ইইউ জোট ছাড়ার পক্ষে মত দেয়। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে গত ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে পৃথক হয় বৃটেন। ঘোষণা অনুযায়ী সেদিন রাত এগারটায় এ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। তবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এখন ব্রেক্সিট কার্যকরের আগেই সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে উভয় পক্ষ।

মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সাথে কথা বলার সময় ব্লকের প্রধান আলোচক মিশেল বার্নিয়ার বলেছেন, চূড়ান্ত ফায়সালা  উভয় পক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। উভয় পক্ষই ভবিষ্যতে বৃটিশ ফিশিং জলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাক্সেস এবং কোটা নিয়ে বিতর্ক করেছেন। এটি খুব বড় অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং উভয় পক্ষের জন্য উচ্চ রাজনৈতিক প্রভাব প্রধান বিষয় ছিল।

এদিকে ব্যবসায়ী সমাজ থেকে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়ায় এটিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী এমবিই বলেছেন, বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। ফলে গ্লোবাল মার্কেটিং সুবিধা ভোগ করতে হলে এধরণের চুক্তি অপরিহার্য। চুক্তি বিহীন অবস্থা কারো জন্য কাম্য নয়।

বৃটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট বশির আহমদ বলেছেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি বৃটেন ও ইইউ বাসিন্দাদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। ব্রেক্সিটের পরও দুই পক্ষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহাল থাকবে।

ইউকে-বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইউকেবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট নাজমুল ইসলাম নুরু বহুল প্রত্যাশিত ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি হওয়াতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ব্রেক্সিটের পর বৃটেনের জন্য উন্মুক্ত হল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পথ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে ইউকেবিসিসিআই প্রস্তুত রয়েছে।

বার্কলেস ইউকের চেয়ারম্যান স্যার ইয়ান চ্যাশায়ার বলেছেন, ইইউর সাথে বাণিজ্য চুক্তি ব্যবসায়ের স্বচ্ছতা এনে দেবে।

সময়ের অভাবের কারণে ইউরোপের সাথে বাণিজ্য ও সুরক্ষা চুক্তির অনুমোদনের জন্য ইউরোপীয় সংসদে ভোটগ্রহণ আর সম্ভব হয়নি। এমইপিরা বলেছেন, যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। এমইপিরা হয়ত এমাসের শেষে তাদের ভোট দেবেন। ২৭টি সরকার কর্তৃক এই চুক্তির অনুবাদ ও তদন্তের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিবেচনা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877