শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৩ অপরাহ্ন

ট্রাম্পের পরাজয় কট্টর নেতাদের কী বার্তা দিচ্ছে?

ট্রাম্পের পরাজয় কট্টর নেতাদের কী বার্তা দিচ্ছে?

স্বদেশ ডেস্ক:

বিশ্বের অন্যান্য নেতাদের সাথে তার সম্পর্ক কেমন সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সময় ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘যে যতো বেশি শক্ত এবং কঠোর, তার সাথেই আমার ভাল যায়।’ হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারটি ছিল বেশ খোলামেলা।

তিনি তখন বলেছিলেন, ‘যারা খুব সহজ তাদেরকে হয়তো আমি অতোটা পছন্দ করি না, অথবা তাদের সাথে আমার খুব একটা যায় না।’

চার বছর ধরে এই ব্যক্তি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান। বিশ্বের যেখানেই কোনো নেতা শক্ত অবস্থান নিতে চেয়েছেন তাদেরকে তিনি চাঙ্গা করেছেন। তাদের সাফল্যে তিনি তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং সমর্থন জানিয়েছেন তাদের গৃহীত নীতিমালাকে।

এসব শক্ত নেতার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তাদের উত্থানের ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ। তারা জনপ্রিয়তার রাস্তা ধরেছিলেন। সমালোচকরা বলেন, তারা এক রকম কর্তৃত্ববাদেরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠেছিলেন।

এখন বিশ্বের এসব কঠোর নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তাকে কতোটা মিস করবেন?

বিশ্বের কিছু নেতা আছেন যাদের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাজ করেছেন তাদের পথ-নির্দেশক বা চালিকা শক্তি হিসেবে। তাদের একজন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারো। তিনি নিজেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেতার জন্য প্রচারণায় নিজেকে ‘ট্রাম্প অফ দ্য ট্রপিক্স’ বা ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ট্রাম্প’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র দু’বছর পর ১৫ নভেম্বর বিভিন্ন শহরের মেয়র নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বলসোনারো
যাদেরকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের দুই তৃতীয়াংশই হেরে গেছেন। এর মাত্র কয়েক দিন আগে হেরে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এ দুটো পরাজয়ের মধ্যে কাকতালীয় মিলের বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজর এড়ায়নি।

করোনাভাইরাস মোকাবেলার উপায় থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যুতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কঠোর অনুসারী ছিলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো তিনিও মাস্ক পরাকে গুরুত্ব দেননি। তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালার কারণে বিশ্বের বৃহৎ অরণ্য আমাজন ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবেশবাদীদের এ ধরনের উদ্বেগকেও তিনি পাত্তা দেননি। শুধু তাই নয় এ বছরের শুরুর দিকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার টুপি পরিহিত তার কিছু ছবিও ছাপা হয়েছে।

ফরাসি সংবাদপত্র লা মঁদ লিখেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যারা হেরেছে তাদের একজন’ এই জায়ের বলসোনারো।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ওই অঞ্চলের বাইরেও ট্রাম্পের অনুসারী এরকম আরো কিছু ‘শক্ত নেতা’ রয়েছেন উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তেও।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও নিজেকে প্রথাবিরোধী রাজনীতিক হিসেবে মনে করেন। গত বছর তিনি যখন সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বরিস জনসনকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন একজন ‘টাফ ও স্মার্ট’ নেতা হিসেবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, ‘তারা তাকে ব্রিটেনের ট্রাম্প হিসেবে ডাকে।’ব্রেক্সিট ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কঠোর অবস্থান নিতে বরিস জনসনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন আমেরিকার এ প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চলে আসার ব্যাপারে ছাড় দেয়া হলে (সফ্ট ব্রেক্সিট) যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের দ্রুত কোনো চুক্তির সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বার বার মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ করার কথা বলেছেন ব্রিটেনে বরিস জনসনের সরকার তখন অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের ঠেকাতে ইংলিশ চ্যানেলে নৌবাহিনী মোতায়েনের কথাও বিবেচনা করেছে।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখনই জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে বেশিরভাগ সময়ই যুক্তরাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রেখেছে।

পোল্যান্ডের ব্যাপারেও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে ট্রাম্প তার পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনার জন্য তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন।

তারা বলছে, নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে দেশটির রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে ডুডার সাথে সাক্ষাৎ ও তার প্রশংসা করা এবং জার্মানি থেকে মার্কিন সৈন্যদের সরিয়ে পোল্যান্ডের পুনরায় মোতায়েন করার কথা ঘোষণা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জুলাই মাসের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হতে তাকে সাহায্য করেছেন।

তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ইউরোপের দক্ষিণপন্থীদের যে মৈত্রী-বন্ধন সেটা পরস্পরকে সমর্থন দেয়ার মধ্যেই সীমিত, বলেন প্রফেসর ক্যাস মুডে, জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ‘ফার রাইট টুডে’ (২০১৯) বই এর লেখক।

হাঙ্গেরিতে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন ভিক্টর ওরবান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথেতার নীতিমালার বেশ কিছু মিল উল্লেখ করার মতো। তার মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের নামে কুৎসা রটানো, সামাজিক বিভক্তিকে উস্কে দেয়া, সংবাদ মাধ্যমকে আক্রমণ করা এবং নিজেদের স্বার্থে ভুয়া খবর বা ফেক নিউজ ব্যবহার করা।

অধ্যাপক মুডে বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভিক্টর ওরবান, আন্দ্রে ডুডা এবং ইতালির মাত্তিও সালভিনির ‘সমালোচনা করেননি এবং তাদেরকে সবকিছুকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছেন’ এটাই তাদের প্রতি ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সাহায্য।

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনৈতিক বিতর্কে ট্রাম্পের আধিপত্য, ক্রমাগত কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া- এসব রাজনীতির মানদণ্ডকে বদলে দিয়েছে। যেসব রাজনীতিক ও বিবৃতিকে এক সময় অতি-দক্ষিণপন্থার খুব কাছাকাছি বলে বিবেচনা করা হতো, সেগুলো যেন এখন মূলধারার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি যা কিছু বলেন সেটাকেই একসময় স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করা হয়।’

আমেরিকায় অতি-দক্ষিণপন্থাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে সামাল দিয়েছেন সেটা তার শাসনামলে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর একটি। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোর নিন্দা জানাতে তিনি দ্বিধা করেছেন। প্রথম নির্বাচনী বিতর্কের সময় এসবের নিন্দা জানাতেও তিনি অস্বীকৃতি জানান।

তাকে বার বার বলা হয়েছিল ‘প্রাউড বয়েজ’ নামের একটি গ্রুপকে নিন্দা করতে। এটি শুধুমাত্র পুরুষদের নিয়ে গঠিত একটি নব্য ফ্যাসিবাদী সংগঠন। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই এই গ্রুপটিকে ‘চরমপন্থী গ্রুপ’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ট্রাম্প তাদের নিন্দা করতে অস্বীকৃতি জানান।

ফিনল্যান্ডের আবো একাডেমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ওসকার উইনবার্গ মতে, এ বারের নির্বাচনেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণায় ‘রাজনীতিকে অপমান’ করা হয়েছে, যেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের খাটো করে দেখা হয়েছে এবং তাদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গ পরিহাস করা হয়েছে।

উইনবার্গ আরো বলেন, ট্রাম্পের পরাজয় দেখিয়ে দিয়েছে যে এ ধরনের রাজনীতি কতো দূর পর্যন্ত যেতে পারে তারও একটা সীমা রয়েছে। ট্রাম্পের প্রচারণা এবং রাজনীতিকে তিনি যেভাবে অপমান করে গেছেন সেগুলো দক্ষিণ-পন্থী টক-রেডিও এবং সংবাদ মাধ্যমে প্রচার পেয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের রাজনীতিকে বদলে দিয়ে নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা করেছে।’

তার মতে ২০১৬ সালের নির্বাচন যেমন ট্রাম্পের রাজনীতির সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে তেমনি ২০২০ সালের নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় এর সীমাবদ্ধতা।

উইনবার্গ আরো বলেন, ‘সারা বিশ্বের দক্ষিণ-পন্থী জাতীয়তাবাদীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্টাইলকে অনুসরণ করলেও তারা সেদেশের দক্ষিণ-পন্থী মিডিয়াকে তাদের পাশে পায়নি। কিন্তু ট্রাম্পের সাফল্যের পেছনে এসব মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

উইনবার্গ মনে করেন, ট্রাম্পের এই পরাজয়ের প্রভাব পড়তে পারে সারা বিশ্বের দক্ষিণ-পন্থী রাজনীতির ওপর।

তার মতে ‘অপমান ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সংঘাতের রাজনীতির মতো বিষয়গুলো অন্য নেতারাও এখন নতুন করে ভেবে দেখবেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প অন্যান্য দেশের দক্ষিণ-পন্থী নেতাদের সমর্থন যুগিয়েছেন। এখন হোয়াইট হাউজে তার অনুপস্থিতির ফলে অন্যান্য দেশে তাদের রাজনীতি পরীক্ষার মুখে পড়বে।’

উইনবার্গ মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ট্রাম্প না থাকার কারণে বিশ্বায়ন-বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যতও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। ট্রাম্পের শাসনামলে বিজ্ঞান-বিরোধী এই ধারাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল।

গত চার বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তি এবং জেনেভায় জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও তিনি বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেবেন।

এর পরে কী?
অনেকেই আশা করছেন যে ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোতে দক্ষিণ-পন্থী রাজনীতি ‘সমাপ্ত হওয়ার সূচনা হয়েছে।’

ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টুস্ক জো বাইডেনকে তার বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে যে টুইট করেছেন তাতে তিনি লিখেছেন, ‘ইউরোপে অতি-দক্ষিণ-পন্থী পপুলিজম রাজনীতির যে বিজয় হচ্ছিল ট্রাম্পের পরাজয়ের ফলে তার পতন শুরু হতে পারে।’

কিন্তু প্রফেসর মুডে এই মন্তব্যের সাথে একমত নন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী সাফল্যের সাথে অন্যান্য দেশের দক্ষিণ-পন্থী রাজনৈতিক দলের পথ সমান্তরাল নয়।

উইনবার্গ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব কঠোর নেতা আছেন তারা ট্রাম্পের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। তবে এটা নির্ভর করে এখন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যারিয়ার কোন পথে যায় তার দিকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোট কারচুপির যে অভিযোগ করছেন, সেটা যদি তিনি মূলধারায় নিয়ে আসতে পারেন তখন কী হবে?

উইনবার্গ বলেন, ‘এরকমটা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে দক্ষিণ-পন্থী পপুলিস্ট রাজনীতিকরা জার্মানি থেকে এস্তোনিয়া পর্যন্ত তাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি কীভাবে অনাস্থা প্রকাশ করছেন। এর পরের ধাপ নির্ভর করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার মিত্ররা নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের চ্যালেঞ্জ কতোটা অব্যাহত রাখতে পারেন তার ওপর।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877