বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০২ অপরাহ্ন

চট্টগ্রামে সংসার বিলীন হচ্ছে বিচ্ছেদে!

চট্টগ্রামে সংসার বিলীন হচ্ছে বিচ্ছেদে!

স্বদেশ ডেস্ক: নাসির উদ্দিন ও শায়লা আকতার সোহা কর্মসূত্রে থাকেন চট্টগ্রামে। তাদের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়ায়। ভালোবেসে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয় ইউপি চেয়ারম্যান পুত্র নাসির ও সোহার। বছর ঘুরতেই ঘর আলো করে আসে পুত্রসন্তান। সুখেই কাটছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু হঠাৎ স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে তাদের দামপত্য জীবন হয়ে উঠে বিষাদময়। ইংলিশে অনার্স ও মাস্টার্স পাস সোহা বলেন, আমি নাসিরকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছি। ফেরাতে পারিনি। কারণ আমার শাশুড়িও পরকীয়ার বিষয় জেনেশুনে ছেলের পক্ষে মদত দিচ্ছিলেন। আমি মনে করেছিলাম আরেকটি সন্তান নিলে মনে হয় সে ফিরে আসবে পরকীয়া থেকে। কিন্তু আমার একটি মেয়েশিশু হওয়ার পরও তার কোনো পরিবর্তন দেখিনি। শেষে উপায়হীন হয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাঁচ বছরের সংসারের ইতি টেনে চলে আসতে হলো। চট্টগ্রামে এভাবে প্রতিদিনই বহু সংসার বিলীন হচ্ছে বিচ্ছেদের গর্ভে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য, পরসপরের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক নানা অভিঘাতের ফলে মুহূর্তেই ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার বন্ধন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণীর মধ্যেই ডিভোর্সের প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সেপশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে এ তথ্য। প্রতিবেদন মতে, ৯০ দিন অতিক্রান্ত সূত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে আড়াইশো। বেশির ভাগ দমপতিই বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েই মামলায় আসেন। এর মধ্যে ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রেই বিবাহ-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে গড়ে মাত্র ২ শতাংশ দমপতি আপসে যায়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় আপোস হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম। যদিও দেশের সবচেয়ে বেশি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে ঢাকা মহানগরীতে। ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় তালাক হয় একটি করে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সেপশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সেপশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস জানান, আসলে আমাদের কাছে যখন দম্পতিরা আসেন, তারা বিবাহ-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েই আসেন। তো সেই অবস্থায় তাদের ফেরানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রেই বিবাহ-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। শুধুমাত্র ২ শতাংশ দম্পতি আপসে যায়। তিনি জানান, মূলত ডিভোর্স হয়ে থাকে মাদকদ্রব্য সেবন, ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে পরকীয়া, পারিবারিক কলহসহ আরও কিছু কারণে। চটগ্রাম নগরীতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণীর মধ্যেই ডিভোর্সের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জাহানারা ফেরদৌস জানান, আমি তরুণ সমাজকে বলতে চাই বিয়ে মানে শুধু অবাধ দৈহিক মিলন নয়। বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক ইনস্টিটিউশন। বিয়ের সংজ্ঞাটাই হচ্ছে সামাজিক স্থাপনা যা সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত সেই স্থাপনা পরিপক্ক না হবে, ততোক্ষণ সমাজে বিয়ে রয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু সমপর্ক ভাঙতে থাকবে। বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কারিতাস। সংস্থার চট্টগ্রামের মাঠ কর্মকর্তা পারুল আক্তার বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। এতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের শুরু থেকে প্রতিদিন শত সংসার ভাঙছে। ২০১৬ সালের দিকে প্রতিদিন ১৪টি সংসার ভাঙার তথ্য উঠে আসে। এর আগে ২০১৩ সালে ভাঙত ৩টি সংসার। তিনি জানান, মাদক ও মোবাইল ফোনে আসক্তি, মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে মেয়েরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পর একক সিদ্ধান্তে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নিচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া। স্ত্রীর করা আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের সপক্ষে যেসব কারণ দেখানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সমপর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ আরও বিভিন্ন কারণ। অন্যদিকে স্বামীর আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের সপক্ষে দেখানো হয় অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দামপত্য জীবনে যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকার কথা সেটা এখন আর কাজ করছে না। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে এসে স্বাধীন হতে গিয়ে স্বাধীনতার অপব্যবহার হচ্ছে বেশি। স্কুলশিক্ষিকা শারমিন ইসলামের মতে, মূলত পারিবারিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, প্রযুক্তির অপব্যবহার, পারিবারিক বিনোদনের অভাব, শহরের যান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা, পরসপরের প্রতি সম্মান ও বিশ্বাসের অভাব, প্রযুক্তির কল্যাণে ভিন্ন নারীতে আসক্তি, খাদ্যের গুণগতমানের অভাবে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং অতিমাত্রায় কৃত্রিমতাই মূলত বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ। মাদ্রাসাশিক্ষক গোলাম সারোয়ার জানান, বিবাহের মত পবিত্র সমপর্কে ছেদ ঘটছে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? তার মতে, মূলত উচ্চশিক্ষা, আর্থিকভাবে স্বনির্ভরতা ও অধিকার সচেতনতায় নারীরা জেদি হয়ে উঠছে। এই জেদই সংসার ভাঙ্গার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877