রায়হানের মা সালমা বেগমের মতে- ‘তার ছেলেকে টাকার জন্য খুন করা হয়নি। এর পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে। যে রহস্যের জট এখনো খোলেনি। পুলিশ রহস্য জানে, কিন্তু প্রকাশ করছে না বলে দাবি করেন তিনি।’ পরিবারের মতে- রায়হান কখনোই রাত ১০ টার পর বাইরে বের হয় না। রিকাবীবাজার ডাক্তারের চেম্বারে ডিউটি শেষে বাড়ি চলে যায়। আর বের হয় না। তবে- ঘটনার দিন রায়হানের স্ত্রী ও সন্তান শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। রায়হানের মা সালমা বেগম থাকেন অন্য বাড়িতে। দাদার সম্পত্তিতে রায়হান কেবল একাই থাকে। সঙ্গে তার চাচাত ভাইরা রয়েছেন। ফলে রায়হান বাড়ি ফিরেছে কি না- সে খবর কেউ নেননি। রায়হানের স্বজনরা জানিয়েছেন- যে ছেলে রাত ১০ টার পর বাড়ির বাইরে বের হয় না সেই ছেলে রাত দুই টায় কীভাবে কাস্টঘরে যায় সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কাস্টঘরের বাসিন্দারা জানিয়েছে- রায়হানকে তারা চিনেন না। কখনোই তাকে ওই এলাকায় দেখেননি। পুলিশ গ্রেপ্তারের কিছুক্ষণ আগে রায়হান কাস্টঘরের তিন তলার একটি ঘরে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রায়হান আশ্রয় নেয়ার পরপরই পুলিশ পেছনে গিয়ে ওই ঘরে ঢুকে। এরপর রায়হানকে হাতকড়া পড়িয়ে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসে। মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই জানিয়েছে- রায়হানকে ছিনতাইকারি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তিকে পরবর্তীতে পিবিআই শনাক্ত করেছে। এবং তাকে পিবিআই হেফাজতে নেয়া হয়। রোববার তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। আটক সাইদুর বন্দরবাজার পুলিশের সোর্স হতে পারে। তাকে দিয়ে নাটক সাজানো হতে পারে। সুতরাং পিবিআই তদন্তের স্বার্থে আপাতত তাকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করেছে। প্রয়োজন হলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে- কাস্টঘর থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশের হাতে আটকের সময় রায়হান চিৎকার করে বলছিল- ‘আমি চোর না, ডাকাত না। আমাকে আপনারা নিয়ে যাবেন না।’ বন্দরাবাজার ফাঁড়িতেও নির্যাতনের সময় একই কথা বলছিল রায়হান। তাকে মারধরের সময় উপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্য এবং প্রতিবেশীরাও রায়হানের এই আর্তনাদ শুনেছেন। তবে- আদালতে সাক্ষ্য দেয়া তিন পুলিশ সদস্যের জবানবন্দিতে উঠেছে অন্য তথ্য। নির্যাতনের সময় এসআই আকবর বলছিলেন- ‘পুলিশকে কষ্ট দিয়েছো, এতো কষ্ট করতে হয়েছে তোকে ধরতে।’- এ কথা বলে এসআই আকবর, কনস্টেবল টিটু ও হারুনুর রশীদ তাকে মারধর করে। তার মারধরের দৃশ্য দেখে ওইদিন বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকা পুলিশ সদস্যরাও হতবাক হন। কেউ কেউ এ সময় আকবরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। রায়হান মারা যেতে পারে বলে সতর্কও করে দেন। এরপরও আকবর রায়হানকে ছাড় দেয়নি। বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন- রায়হানকে পিটানোর সময় এসআই আকবর হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এভাবে আগে কখনো আকবর কাউকে মারধর করেননি। রায়হানের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের কারণে রায়হান বার বার মুর্ছা যাচ্ছিল। রায়হানের পরিবারের ধারণা- রায়হানকে গ্রেপ্তারের পর ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়েছে। কারণ- রায়হানের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল রাত ১০ টার পর থেকে। রায়হান বাসায় রয়েছে সবাই ধারণা করার কারণে ওই সময় তার খোঁজ নেননি। রায়হানকে রাত ১০ টার পরই গ্রেপ্তার করেছে ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁইয়া। এরপর থেকে রায়হান তাদের হেফাজতেই ছিলেন। শেষ রাতের দিকে ছিনতাই নাটক সাজিয়ে রায়হানকে আটক দেখিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এই নির্যাতনের পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে বলে জানান তারা। রায়হানের মা সালমা বেগম জানিয়েছেন- রায়হানকে কোথায় থেকে, কেন গ্রেপ্তার করা হলো সেটি স্পষ্ট করছে না পুলিশ। আর কেনই বা রায়হানকে নির্যাতন করা হলো তাও বলছে না। আকবর ছাড়া পুলিশের অন্য সদস্যরা বিষয়টি জানতে পারে। কিন্তু রিমান্ডে থেকে তারা এখন মুখ খুলছে না। সুতরাং রায়হান হত্যার তদন্ত নিয়ে পুলিশই রহস্যর জন্ম দিয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে- রায়হান হত্যার বিষয়টি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই। ইতিমধ্যে পিবিআই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছে। পিবিআইয়ের কাছেও স্পষ্ট হয়েছে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে রায়হানের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাকে আটক দেখানো হয়েছে নগরীর কাস্টঘর থেকে। ওখানে কোনো গনপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। তবে- কী কারণে রায়হানের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ইনপেক্টর মুহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন- অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে পলাতক থাকা আকবর গ্রেপ্তার হলে। এ কারণে আকবরকে গ্রেপ্তার করতে পিবিআই সহ পুলিশের একাধিক ইউনিট ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন বলে জানান তিনি।