ডা. রওশন আরা খানম: ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দু’ভাবেই কাশি হতে পারে। কাশি অনেককে বেশ ভোগালেও এটা কিন্তু রোগ প্রতিরোধের একটি প্রাকৃতিক উপায়। অতিরিক্ত কাশি কোনো রোগের লক্ষণ হিসেবেও ঘটতে পারে।
হঠাৎ ও সজোরে ফুসফুসের বাতাস সশব্দে বের হওয়াই কাশি। এর মাধ্যমে শ্বাসনালি ও ফুসফুস থেকে বাইরের বস্তু, জীবাণু, মিউকাস নিষ্ক্রান্ত হয়ে ফুসফুসকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখে। এটি একটি রিফ্লেক্স ক্রিয়া, যার রিসেপটর থাকে শ্বাসনালিতে। এ ছাড়া পাকস্থলী, খাদ্যনালি, ডায়াফ্রাম, স্বরযন্ত্র ও পেরিকার্ডিয়ামেও কাশির রিসেপটর থাকে। রিসেপটর থেকে কাশির উত্তেজনা ভেগাস নার্ভ দিয়ে ব্রেনের মেডুলায় পৌঁছে। সেখান থেকে স্পাইনাল নার্ভ, ভেগাস নার্ভ ও ফ্রেনিক নার্ভ হয়ে শ্বাস ত্যাগের মাংসপেশি ডায়াফ্রাম, শ্বাসনালিতে উত্তেজনা প্রবাহিত হয়ে কাশির উদ্রেক করে।
প্রকারভেদ: স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করে কাশি তিন ধরনের হয়। এগুলো হলোÑঅ্যাকিউট, সাব-অ্যাকিউট ও ক্রনিক।
অ্যাকিউট: যখন কাশির স্থায়িত্ব তিন সপ্তাহ হয়, তখন সেই ধরনের কাশি অ্যাকিউট পর্যায়ের। যেমনÑফুসফুসে ও শ্বাসনালিতে জীবাণু সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, পালমোনারি অ্যামবলিসম ইত্যাদি।
সাব-অ্যাকিউট: তিন থেকে সপ্তাহকাল পর্যন্ত যে কাশি থাকে, তা সাব-অ্যাকিউট। ফুসফুসে জীবাণু সংক্রমণ-পরবর্তী কাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়।
ক্রনিক কাশি: আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী কাশিই ক্রনিক পর্যায়ের। যেমনÑপোস্ট ন্যাজাল ড্রিপ রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, সিওপিডি, আইএলডি, ফুসফুসের এবসেস, ক্যান্সার, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-বিটাব্লকার, এসিই ইনহিবিটর নামক রক্ত চাপের ওষুধের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
জটিলতা: কাশি হওয়ার সময় বুকের ভেতর ৩০০ মিমি মারকারি চাপ তৈরি করে এবং ফুসফুস থেকে প্রায় ৫০০ মাইল গতিবেগে বাতাস প্রবাহিত হয়। এ কারণে বুকে ব্যথা, মাথা ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা (বিশেষত নারী ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে), হার্নিয়া, বুকের হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়।
পরীক্ষা: ঠিক কী ধরনের কাশি হয়েছে তা জানার জন্য রক্তের সিবিসি, বুকের এক্স-রে, শ্লেষ্মার রুটিন মাইক্রোস্কপিক কালচার সেনসিটিভিটি, এমটি ইত্যাদি পরীক্ষাগুলো করতে হয়। এ ছাড়া অ্যাজমা নির্ণয়ের জন্য স্পাইরোমেট্রি ও রিভারসিবিলিটি পরীক্ষা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান, ব্রংকোসকপিও করা লাগতে পারে।
চিকিৎসা:চিকিৎসার আগে কাশির সঠিক কারণ বের করা উচিত। সচরাচর কাশি নিরোধক ওষুধ ব্যবহার করে কাশি বন্ধ করার চেষ্টা করা ঠিক নয়।
এ ছাড়া কিছু করণীয় হলো:Ñকাশি উদ্রেককারী কোনো ওষুধ রোগী সেবন করছে কি না তা দেখা। অনেক সময় পোস্টন্যাসাল ড্রিপের লক্ষণ থাকে না। সে ক্ষেত্রে রোগীকে অন্তত সাত দিন স্টেরয়েড ন্যাসাল স্প্রে দিয়ে দেখা উচিত। অনেক সময় অ্যাজমার লক্ষণও দেখা দিতে পারে, এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক হতে হবে। খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর রিফ্ল্যাক্স সিøপ এপনিয়া কাশির অজানা কারণ। এতে অনেক কষ্ট হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১০-২০ শতাংশ রোগীর কাশির কারণ জানা যায় না। মানসিক রোগের বিষয়টি মাথায় রেখে তখন চিকিৎসা দিতে হয়। রক্তকাশি হলে কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে তাকে রক্তকাশি বলে। রক্তের পরিমাণ শ্লেষ্মায় রক্তের দাগ থেকে শুরু করে শ্লেষ্মাহীন শুধু রক্ত কাশিতে যেতে পারে। এটা শ্বাসনালি, ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গের সমস্যায়ও হতে পারে।
যে কারণেই হোক না, রক্তকাশি রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের জন্যই একটি ভীতিকর লক্ষণ। এ রকম মনে হলে প্রথমেই কাশিতে রক্তের পরিমাণ দেখতে হবে। যদি ২৪ ঘণ্টায় ৫০০ মিলি বা তার বেশি রক্ত যায়, তাকে ম্যাসিভ বা বৃহদায়তন রক্তকাশি বলে। এ ধরনের রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। বিশেষত ফুসফুসের শ্বাসনালি রক্তে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে ফুসফুসের অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের আদান-প্রদান ব্যাহত হয়ে রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এ কারণে ম্যাসিভ রক্তকাশির রোগীকে তাৎক্ষণিক আইসিইউতে ভর্তি করে শ্বাসনালিতে টিউব দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। যে ধমনি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে ধমনিতে এমবোলাইজেশন করতে হবে অথবা ফুসফুসের এই অংশটি কেটে বাদ দিতে হবে।
রক্তের পরিমাণ কম হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় রক্তকাশি সেরে যায়। চিকিৎসার পরও যদি না সারে, সে ক্ষেত্রে ধমনি এমবোলাইজেশন ও সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে রোগ ধরা পড়ে না, সেসব রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ে ফলো আপ দিতে হবে।