স্বদেশ ডেস্ক: ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুট দুটি আন্ত:নগর রুট এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম রুট। কিন্তু এ দুই রুটের যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। জীর্ণশীর্ণ কোচ (বগি), লক্কড়-ঝক্কড় ইঞ্জিন। সেবার মানও ভালো নয়। নির্ধারিতের চেয়ে গতি বাড়ালেই দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে এ দুটি রুটে যাত্রীদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বলা যায়, নিতান্তই বিরক্তিকর। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৯৬ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার। ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচল করে আটটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের দূরত্ব ৩৭৭ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার। এ রুটে দুটি করে চলাচল করে চারটি আন্ত:নগর ও দুটি মেইল ট্রেন। মেইল ট্রেনগুলোর দুরবস্থা তো রয়েছেই, আন্তঃনগরের ট্রেনগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সুযোগ-সুবিধা ও মানে এই রুটের আন্তঃনগর ট্রেন অনেক রুটের লোকাল ট্রেনের চেয়েও খারাপ। এ নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই।
ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচল করে আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস ও কালনী এক্সপ্রেস। এ ছাড়া একবার করে চলাচল করে সুরমা মেইল। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস। একবার করে আসা-যাওয়া জালালাবাদ মেইলের। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে চলাচলকারী প্রায় সব ট্রেনের কোচ যেমন পুরনো, আসনগুলোও নড়বড়ে। অনেক কোচের আসন থেকে আরামের ফোম ক্ষয় হয়ে উঠে গিয়ে কাঠ বেরিয়ে এসেছে। হাতলে বেরিয়ে এসেছে লোহাও। কিছু কিছু কোচের আসনে ছারপোকার নির্ভেজাল আবাস, বসা যায় না। ওঠানো-নামানো যায় না অনেক জানালা। ওয়াশরুমের শোচনীয় অবস্থা। বাতি জ্বলে না, থাকে না পানিও। কোচে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য অ্যাটেনডেন্ট থাকার কথা থাকলেও প্রয়োজনে দেখা পাওয়া যায় না তাদের। সেবা দেওয়ার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীদের টাকার বিনিময়ে মোড়ায় বসার ব্যবস্থা করে দিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাদের। স্বস্তিতে ভ্রমণ করা যায় না হকারের নিরবচ্ছিন্ন উপদ্রবে। পাহাড়িকা ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রী রবিন মল্লিক জানান, আরামে যাওয়ার জন্য ট্রেনে ভ্রমণ করতে গিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওয়াশরুমের অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে এগুলো ব্যবহার করা যায় না। শক্ত কাঠের মতো চেয়ারে বসে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়। আলো-বাতাস পাওয়া যায় না। কোনো একটা বাতি জ্বললে আরেকটি জ্বলে না। লাইটশেডগুলোতে ময়লার পুরু আস্তরণ জমায় আলো বের হয় না। সুযোগ-সুবিধায় লোকাল ট্রেন ও আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে এমন পরিস্থিতি থাকবে না বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি জানান, শিগগিরই ২০০টি মিটারগেজ কোচ আসছে। এই কোচগুলো নিয়ে ১৫টি ট্রেন চালানো যাবে। কোচগুলো পাওয়া গেলে ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের পুরনো ও জরাজীর্ণ কোচের পরিবর্তে নতুন মিটারগেজ কোচ সংযোজন করা হবে। তবে চলতি বছরের মধ্যেই কালনী এক্সপ্রেস নতুন কোচ দিয়ে সাজানো হবে। একই সঙ্গে বাড়ানো হবে সেবার মানও।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেলে বর্তমানে ইঞ্জিন ও কোচের মারাত্মক সংকট রয়েছে। বর্তমানে রেলের পূর্বাঞ্চলে ১৫২টি ইঞ্জিনের প্রয়োজন হলেও রেলের বহরে যুক্ত হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ১০৫টি। অর্থাৎ প্রতিদিন চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ ইঞ্জিন ঘাটতি থাকে। এ ছাড়া বর্তমানে রেলের বহরে যেসব ইঞ্জিন রয়েছে, সেগুলোর গতি খুব কম। কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় এসব ইঞ্জিনে গতি বাড়ালেই বন্ধ হয়ে পড়ে, নতুবা দুর্ঘটনা ঘটে। মূলত পুরনো ইঞ্জিনগুলো মেরামত করে কোনোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গতিতে চলতে গিয়ে গত ২৩ জুন সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যাত্রীবাহী ট্রেন উপবন দুর্ঘটনায় পড়ে বলে মনে করা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় চারজন নিহত ও প্রায় দুইশ যাত্রী আহত হন। গতি বাড়ানো ছাড়াও চালকের ভুল, যান্ত্রিক ত্রুটি ও অতিরিক্ত যাত্রীর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন খোদ রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। কুলাউড়ার বরমচালে এক পথসভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, কোচের সংকটও রয়েছে খুব বেশি। তবে ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে বেশ কিছু কোচ আমদানি করা হচ্ছে। কিছু কোচ এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন কোচ পাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। চীনের সিআরআরসি সিফাং কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে ৯২৭ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা (আট কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার) ব্যয়ে ২০০টি মিটারগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ার (কোচ) কিনছে রেলওয়ে। সম্প্রতি রেল ভবনে এ ব্যাপারে সিআরআরসি সিফাং কোম্পানি লিমিটেড ও রেলওয়ের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিটি ২০ থেকে ২৭ মাসের মধ্যে সব কোচ সরবরাহ করবে। ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ভালো মানের ও পর্যাপ্ত কোচ দিতে না পারার কথা স্বীকার করেন ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, রেলে কোচের সংকট রয়েছে। ভালো মানের কোচের সংকট আরও বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটসহ এ ধরনের রুটগুলোতে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে ভালো মানের কোচ সংযুক্ত করা হয়। ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুট গুরুত্বপূর্ণ হলেও নানা কারণে ভালো কোচ দেওয়া যাচ্ছে না। নতুন কোচ না আসা পর্যন্ত এ দুটি রুটে ভালো মানের কোচ সংযোজন করা রেলের পক্ষে সম্ভব নয়।