সুমনা ইয়াসমিন:
এখন যাঁরা বৃদ্ধ তাঁরা নিজেদের জীবনের সকল সময়, ধন সম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও পাচ্ছেন না। কখনো দেখা যায় সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই বাবা-মাকে মনে করছে বোঝা। বাবা-মার ঠাঁই করে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায় যে সন্তানের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। সন্তানের অবহেলা-দুর্ব্যবহারে বাবা-মা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে।
পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা-মাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সকল দায়মুক্তি। যাঁরা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়স্বজন আর তাঁদের কোনো খবরও নেন না। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে বা ঈদের সময়ও বাবা-মাকে বাড়িতে নেন না।
বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। এখানে তাঁরা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সকল প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না তা হলো পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারা জীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গীসাথি পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না, যার জন্য তাঁরা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হূদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎ্সা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোনো না কোনো সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ এদের সঙ্গে বাবা-মায়ের যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন। দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামীদিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর বাবা-মায়ের শেষ ঠিকানা যেন কোনোভাবেই বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।