স্বদেশ ডেক্স: বরগুনায় প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। এরই অংশ হিসেবে রিফাতের স্ত্রী মিন্নির নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে নানা অপপ্রচার শুরু করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড এবং তার সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজীর পক্ষে এ প্রচার চলছে।
এই দুই ঘাতক বরগুনার দুই প্রভাবশালী এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছিল ০০৭ নামে সন্ত্রাসী গ্রুপ। যে গ্রুপের প্রধান ছিল নয়ন বন্ড। আর ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় স্থানীয় থানা পুলিশেরও কারো কারো সঙ্গেও নয়ন বন্ডের ছিল গভীর সখ্য। এমন অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্র বলছে, বরগুনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেলোয়ার হোসেন ও এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। কিন্তু নয়ন বন্ড বাহিনী উভয় শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে আসছিল। অভিযোগ রয়েছে, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের প্রভাবে নয়ন বন্ড অপকর্ম চালাত। যে কোনো মামলায় আটক বা গ্রেপ্তার হলে সুনাম দেবনাথের তদবিরেই সুবিধা পেত প্রশাসন থেকে। এমপিপুত্রের কারণেই পুলিশ একাধিকবার নয়ন বন্ডকে আটকের পরও ছেড়ে দেয়।
এ ছাড়া মামলায়ও সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ দুই প্রভাবশালী গ্রুপের ছত্রছায়ায় বরগুনা শহরের বিভিন্ন মেসে প্রায়ই নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর বাহিনীর সদস্যরা হানা দিয়ে মোবাইল ফোনসেট ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিত। অনেক মেসে কৌশলে তাদের ভাড়া করা নারী ঢুকিয়ে দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাততো বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ এ গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ ও মাদক মামলা রয়েছে। কিন্তু তাদের কিছুই হতো না। কারণ রিফাত ফরাজীর আপন খালু বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি স্থানীয় আওয়ামী নেতা দেলোয়ার হোসেন। এলাকার অনেকের অভিযোগ, সুনাম দেবনাথ এবং দেলোয়ার হোসেনের প্রভাবে অপ্রতিরোধ্য ছিল নয়ন বন্ড।
তবে সুনাম দেবনাথের দাবি, একটি পক্ষ নয়ন বন্ডের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। একবার রিফাত ফরাজীকে আটক করে থানায় দেওয়ার পরও দেলোয়ার হোসেন তদবির করে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।
অন্যদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, নয়ন বন্ডের গডফাদার তো সুনাম দেবনাথ। এ অঞ্চলে তার মাধ্যমে মাদক ঢুকেছে। এলাকায় আমি জনপ্রিয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাকে ভালোবাসে বলে একটি গ্রুপ ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার সুনাম নষ্টে উঠেপড়ে লেগেছে।
কেন খুনিরা এতটা বেপরোয়া ছিল-এমন প্রশ্নে এলাকাবাসী জানান, বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ায় নয়ন ও রিফাত ফরাজীরা দিনদুপুরে একজনকে খুন করতেও দ্বিধা করেনি। তাদের বিশ্বাস ছিল, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছায়া তাদের মাথার ওপর তো রয়েছেই।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বরগুনায় মাদক এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা ধরনের নেশা। এর মূল হোতা নয়ন বন্ড। পুলিশের সোর্স হিসেবে নয়ন কাজ করে আসছিল। পাইকারি মাদককারবারী হিসেবে নয়ন খুচরা কারবারীদের কাছে মাদক বিক্রির পর সে পুলিশকে খবর দিত। পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরতে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালানোর নামে অনৈতিক বাণিজ্য করত।
এভাবে খুচরা মাদক কারবারীদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে নয়ন পুলিশকে ঘুষ খাওয়ার পথ তৈরি করে দিত। তাই নয়ন পুলিশের কাছেও প্রিয় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও তিনজন গ্রেপ্তার রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামিসহ আরও ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো-এজাহারভুক্ত ১১নং আসামি অলি এবং সন্দেহভাজন তানভীর, মো. সাগর ও কামরুল হাসান সাইমুন।
গতকাল রবিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে অলিকে এবং বিকালে অন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারও আগে এজাহারের ৪নং আসামি চন্দন জয় সরকার, ৯নং আসামি মো. হাসান ও মো. নাজমুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই হিসাবে রিফাত হত্যা মামলায় গতকাল পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গতকাল তার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, আসামি ধরা ঘণ্টা বা সেকেন্ডব্যাপী হয় না। টেকনিক্যাল অনেক বিষয় থাকে। আমরা বিষয়টি নিয়ে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি। আমার আস্থা আছে টিম ও তাদের কাজের প্রতি। তাই কনফিডেন্টলি বলতে পারি-শিগগিরই অন্য আসামিরা ধরা পড়বে।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কতজনকে আটক করা হয়েছে জানতে চাইলে এসপি বলেন, এটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। কারণ অনেকেই গোপনে আমাদের কাছে ইনফরমেশন দিচ্ছেন। আবার অনেককেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব আসামিকে গ্রেপ্তারে রিট রিফাত শরীফের খুনিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ।
এর আগে গতকাল রিট আবেদনটি দায়েরের পর তা শুনানির জন্য উত্থাপন করলে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ তা শুনতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এর প্রেক্ষিতে আজ সকালে নতুন একটি বেঞ্চে রিট আবেদনটি শুনানির জন্য উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, আইজিপি, র্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।