স্বদেশ ডেস্ক:
দেশে খাতাকলমে কোটিপতি ২৪ হাজার ২২০ জন। তারা দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা রেখেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক টাকা জমা রাখার অর্থ এটি সরকারের নজরে দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে কোটি টাকার মালিক আছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা এত কম নয়। আরও অনেকেই কোটি কোটি টাকার বা সম্পদের মালিক হয়েছেন। যারা অবৈধভাবে তা অর্জন করে তথ্য গোপন রেখেছেন।
কোটি টাকার মালিকদের সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের জমানো অর্থের পরিমাণের তথ্য থেকে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৮৬ হাজার ৩৭টি। গত মার্চে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ তিন মাসে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই অ্যাকাউন্টের বেশিরভাগেরই মালিক ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, সরকারি সংস্থার নামে সঞ্চয়ী হিসাব খোলা আছে। ব্যক্তির সংখ্যা চার ভাগের মাত্র এক ভাগ। জুন পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৩৭টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৬১ হাজার ৮১৭টিই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের। আর ব্যক্তির নামে থাকা অ্যাকাউন্ট ২৪ হাজার ২২০টি। অর্থাৎ সারাদেশে ২৪ হাজার ২২০ ব্যক্তি ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা রেখেছেন।
কোটিপতিদের সম্পর্কে আরেকটি ধারণা পাওয়া যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) এক হিসাবে। আয়কর আইন অনুসারে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের নিয়মিত করের পাশাপাশি সারচার্জ দিতে হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩ হাজার ব্যক্তি এমন সারচার্জ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই কোটিরও বেশি সম্পদ দেখান ১২ হাজার ৮২১ জন।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরের পর থেকে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৬২ জন; ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ হাজার ১৫২ জন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ হাজার ৯৩১ জন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৫৫ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ হাজার ২৩৪ জনে উন্নীত হয়েছে। অবশ্য ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে সীমা কিছুটা বাড়িয়ে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীদের ওপর সারচার্জ বসানো হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আমাদের সময়কে বলেন, আমানতকারী ও করদাতার হিসেবে যে সংখ্যা দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে কোটিপতির সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তথ্যভা-ারের দুর্বলতার কারণে অনেকে সম্পদ লুকিয়ে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন। সরকারের ক্রয় ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও দুর্বলতার কারণে বিপুলসংখ্যক ধনীকশ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা হিসাবের বাইরে রয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের টাকা মানুষের একমাত্র সম্পদ নয়, যারা কোটি টাকা রেখেছেন, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আরও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে হিসাব করলে বোঝা যাবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা কত। এখন সরকারি বিভিন্ন খাতে কর্মরতদের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিকদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এরা বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এবং কর না দিয়ে বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছেন। এদের সঙ্গে কর দিয়েছেন এমন ব্যক্তিকে মেলানো ঠিক হবে না। সম্পদের কর দেওয়া হয় ঐতিহাসিক মূল্যের ভিত্তিতে, বাজারমূল্যের ভিত্তিতে নয়। ৪০ বছর আগে যে দামে বাড়ি কেনা হয়েছে, এখনো সেই দামের ভিত্তিতে সম্পদ দেখানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি সার্বিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা প্রয়োজন। এতে সরকারি সম্পদ নয়ছয় করে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে। তেমনি প্রকৃত আয়ের বিপরীতে কর আদায় সম্ভব হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।
ব্যাংক হিসাবই যে শেষ কথা নয়, এর প্রমাণও ভূরি ভূরি। সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজির গাড়িচালক আবদুল মালেক। পদে ড্রাইভার হলেও তার রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। রাজধানীতে তার রয়েছে কয়েকটি বাড়ি ও গাড়ি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক আবজালের দেশে-বিদেশে রয়েছে কয়েকটি বাড়ি ও বিপুল সম্পদ। একটি ব্যাংক ও একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। আর বাড়িভর্তি টাকা আর জুয়ার আসরে কোটিপতি হওয়া রাজনৈতিক নেতাদের সন্ধান মেলে গত বছরের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে। যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এনু, রুপন, জিকে শামীম, সাহেদ, সেলিম প্রধান ব্যাংকে নয়, টাকার খনি বানিয়েছিলেন নিজের বাড়ি ও অফিসে। মেজর (অব) সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ একেকটি মামলায় কয়েক লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্ত্রীর নামে করেছেন সম্পদ। ফরিদপুরের ছাত্রলীগের সভাপতি ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর ধরে এমন বহু কোটিপতির সন্ধান মিলছে, যাদের সম্পদ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সম্পদের উৎসও স্বাভাবিক নয়।