স্বদেশ ডেস্ক: গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অভিযানে গত তিন বছরে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২২০ জঙ্গি গ্রেপ্তার এবং ৮৮ জন নিহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে এক পর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গিরা। তবে সম্প্রতি তাদের ফের সংগঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন কেউ একজন জঙ্গি সংগঠনের হাল ধরেছে বলে ধারণা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের।
জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাব সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিটিটিসি ও র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি পুলিশকে লক্ষ্য করে রাজধানীর গুলিস্তান ও মালিবাগে দুটি বোমা হামলায় জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ দুটি ঘটনার মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত হওয়ার খবর জানান দিচ্ছে তারা- এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পতনের পর সিরিয়া-ইরাক থেকে ফিরতে চাওয়া জঙ্গিরা নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কর্মকর্তারা।
র্যাবের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে গত ২৬ জুন পর্যন্ত ৬৮৫ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে র্যাবের ২৪১টি অভিযানে নিহত হয়েছে ২৫ জঙ্গি। অন্যদিকে সিটিটিসির পরিসংখ্যান বলছে, হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫৩৫ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ে ১৯টি অপারেশনে ৬৩ জঙ্গি নিহত হয়েছে। র্যাব ও সিটিটিসির অভিযানে এক হাজার ২২০ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। নিহত হয়েছে ৮৮ জন।
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এ মুহূর্তে নিরাপত্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট হুমকি নেই। তবে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং ১ জুলাই সন্নিকটে থাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যদিও আমরা জানি বড় ঘটনা ঘটানোর মতো প্রস্তুতি ও সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই। তার পরও ছোটখাটো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটাতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগের চেয়ে নিরাপত্তা জোরদারও করা হয়েছে। গত তিন বছরে সিটিটিসি ও র্যাবের এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে তিন শতাধিক বর্তমানে জামিনে রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই সাম্প্রতিক সময়ে খোঁজ মিলছে না। জামিন নিয়ে লাপাত্তা হওয়া জঙ্গিরাও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ বলে মনে করছেন র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে অন্তত ৫০ বাংলাদেশি সিরিয়া ও ইরাক যায়। তাদের অনেকেই সেখানে নিহত হয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তবে তাদের মধ্যে যারা জীবিত, তারা আইএসের পতনের পর দেশে ফিরতে চাচ্ছেন। এ জঙ্গিদের নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাদের নিরাপত্তার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সিরিয়া ফেরত জঙ্গি মুতাজ আবদুল মজিদ কফিল উদ্দিন বেপারি ওরফে মুতাজকে গত মে মাসে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার সময় তিন বছর আগে বিশ্বে জঙ্গিবাদের যে পরিস্থিতি ছিল এখন তেমনটা নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক্ষেত্রে সহায়তা কমেছে। সিরিয়া-ইরাকে কথিত খেলাফত পতনের পর জঙ্গিদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ফিরতে শুরু করেছে স্বদেশে। এমন কেউ দেশে ফিরতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে মনে করি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, জঙ্গি পরিস্থিতির ওপর সব সময় কঠোর নজরদারি চালিয়ে আসছে র্যাব। অভিযানের কারণে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না জঙ্গিরা। তবে এটা নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। ১ জুলাই ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাব প্রস্তুত রয়েছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জন নিহত হয়। হলি আর্টিজানের অভিযানের শুরুতেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান।
‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ নামে পরিচালিত কমান্ডো অভিযানে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক অভিযানের পাশাপাশি জঙ্গিবাদবিরোধী ব্যাপক সচেনতা কার্যক্রম চালানো উচিত। যেটা বর্তমানে শুরু হয়েছে। এটা আরও জোরালো করা দরকার। গত মার্চের শেষ দিকে জঙ্গিদের প্রপাগান্ডা চ্যানেলে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ ও ভারতে ‘লোন উলফ’ (একাকী হামলাকারী) হামলার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়। এসব প্রপাগান্ডাকেও বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।