সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ০৯:১১ অপরাহ্ন

ওরা ১২ জন এলাকার আতঙ্ক

স্বদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯

স্বদেশ ডেস্ক: রিফাত শরীফ হত্যামামলার প্রধান চার আসামি যথাক্রমে নয়ন, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও চন্দন। প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে শাহনেওয়াজ রিফাতকে (রিফাত শরীফ) কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ১২ আসামির নাম উল্লেখ করে গত বৃহস্পতিবার থানায় হত্যামামলা করেছেন তার বাবা মো. আ. হালিম দুলাল শরীফ। এ মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় মূল আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড। হত্যাকাণ্ডের সময় দূর থেকে ধারণ করা একটি ভিডিওতে নয়ন বন্ড ও তার প্রধান সহযোগী রিফাত ফরাজীর রামদা দিয়ে রিফাত শরীফকে কোপানোর দৃশ্য দেখা গেছে। তবে রিফাতের বাবার দাবি, এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় আরও অনেকে। তারা ঘটনাস্থল বরগুনা কলেজের ভেতর থেকে রিফাতকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় আনে। কলেজ থেকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে আনতে গিয়ে রিফাত হত্যাকাণ্ডে শিকার হন।

মামলাটিতে ক্রম অনুযায়ী আসামিরা হলো সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড), মো. রিফাত ফরাজী, মো. রিশান ফরাজী, চন্দন, মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রায়হান, মো. হাসান, রিফাত, অলি ও টিকটক হৃদয়। বাকি ৫ থেকে ৬ জন অজ্ঞাত আসামি। এদের সবাই এলাকায় মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) : বরগুনা পৌর শহরের ডিকেপি রোড এলাকার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড)। শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি সড়ক, কেজি স্কুল ও ধানসিঁড়ি সড়কে মূলত নয়নের বিচরণ ছিল। ছিনতাই, ছাত্রদের মুঠোফোন জিম্মি করে টাকা আদায়, ছোটখাটো মারধর থেকে তার অপরাধ প্রবণতা শুরু হলেও ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের কলেজ রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ তাকে আটক করে পুলিশ।

এরপরই নয়ন নাম লাইমলাইটে চলে আসে। ওই মামলায় জামিনে আসার পর সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরপর সে নিয়মিত মাদক কারবারে জড়িয়ে যায় এবং রিফাত ফরাজীকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে। ওই গ্রুপে নয়নের সহযোগী হিসেবে বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কের দুলাল ফরাজীর দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও তার ছোট ভাই রিশান ফরাজী কাজ করত।

মূল নাম সাব্বির আহমেদ নয়ন হলেও কর্মকাণ্ডের জন্য রহস্য উপন্যাসের চরিত্র জেমস বন্ডের নাম নিজের নামে জুড়ে দেয় নয়ন। ফলে সহযোগীরা তাকে ডাকা শুরু করে ‘নয়ন বন্ড’ নামে। রিফাত ফরাজী ও অন্যদের সহযোগিতায় ধানসিঁড়ি সড়ক থেকে শুরু করে শহরজুড়ে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। চুরি, ছিনতাই, লুটপাট, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে নয়নের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় ৮টি মামলা রয়েছে।

রিফাত ফরাজী :রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী সম্পর্কে আপন ভাই। একসঙ্গেই তারা সব অপরাধ কর্মকা- পরিচালনা করে। বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়ক এলাকার দুলাল ফরাজীর ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। ধানসিঁড়ি সড়কের রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির মূল ফটক ও বাসার দরজা তালাবদ্ধ।

ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সকালে ঘরের দরজা তালাবদ্ধ ও বাড়ির গেট ভেতর থেকে আটকানো দেখতে পেয়েছেন তারা। ধানসিঁড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নয়ন বন্ডের ডান হাত ও বাম হাত হিসেবে কাজ করত এই দুই ভাই। মাদক সেবন ও মাদক কারবারই ছিল তাদের মূল পেশা। এদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাই ও ছাত্রদের মেসে ঢুকে মুঠোফোন কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে গুরুতরভাবে যখম করে রিফাত ফরাজী।

এ ছাড়া এ গ্রুপের নিয়মিত সদস্য ছিল আমতলার পার এলাকার চন্দন, বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি রোড এলাকার মো. মুসা, কেওড়াবুনিয়া এলাকার কালাম আকনের ছেলে রাব্বি আকন, কলেজিয়েট স্কুল রোড এলাকার মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, কেজি স্কুল এলাকার রায়হান, একই এলাকার মো. হাসান, সোনালীপাড়া এলাকার রিফাত, একই এলাকার অলি ও টিকটক হৃদয়।

এলাকাবাসী ও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, নয়ন ও রিফাত দীর্ঘদিন ধরে নানা অপরাধে জড়িত থাকলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলত না। বারবার আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ত তারা। গত বুধবার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিফাত ও নয়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।

রিশান ফরাজী : ভুক্তভোগী তরিকুল জানান, একদিন তার সঙ্গে রিফাত ফরাজীর সামান্য কথাকাটাকাটি হয়। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেয়। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস ওই সন্ত্রাসীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে নিজ বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। তবে এতেও ক্ষোভ কমেনি রিফাত ফরাজীর। হুমকি দেওয়ার দেড় মাসের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তরিকুল তার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হন। এ সময় রিফাত ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তরিকুলের মাথায় গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।

২০১৭ সালে বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রকে জিম্মি করে তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করে।

এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ডিকেপি রোডে আমাদের ভাড়া দেওয়া বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি মোবাইল উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।’

চন্দন : চন্দন। রিফাত শরীফ হত্যা মামলার চার নম্বর আসামি। মামলার এজাহারে তার বিস্তারিত পরিচয় ও বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তার বাড়ি বরগুনার আমতলা পাড়। নয়ন বন্ডের সাগরেদ হিসেবে সব সময় তার সঙ্গে ঘোরাফেরা করত। তার নামেও এলাকায় অনেক ধরনের অভিযোগ রয়েছে। রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগের পর বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেপ্তার করে বরগুনা সদর থানা পুলিশ।

মো. মুসা : বাড়ি বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। মামলায় তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি। রিফাতকে হত্যার পর থেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

মো. রাব্বি আকন : মামলার ছয় নম্বর আসামি। তার বাবার নাম কালাম আকন। বাড়ি বরগুনার কেওড়াবুনিয়ায়।

মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত : মামলার সাত নম্বর আসামি। তার বাড়ি বরগুনার কলেজিয়েট স্কুল সড়কে। ঘটনার পর থেকেই সে পলাতক। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সঙ্গে সে এলাকায় ঘোরাফেরা করত বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন। মামলার আট নম্বর আসামি রায়হান। বরগুনা কেজি স্কুল সড়কে তার বাসা। ঘটনার পর থেকে পলাতক।
মো. হাসান মামলার ৯ নম্বর আসামি। শহরের কলেজ রোড এলাকায় বাসা। বাবার নাম এখনও জানা যায়নি। ঘটনার পর থেকেই পলাতক।

রিফাত হত্যা মামলায় এ রিফাত ১০ নম্বর আসামি। তার বাড়ি সোনালী পাড়ায়। তবে ঘটনার পর থেকেই সে এলাকা ছাড়া। অলি সোনালী পাড়ারই আরেক যুবক। অলি এ হত্যামামলার ১১ নম্বর আসামি। হত্যাকাণ্ডে সময় রিফাত শরীফকে বরগুনা কলেজ থেকে টেনে বের করে আনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী গ্রুপের অন্যতম সদস্য ও তাদের সহযোগী। ঘটনার পর থেকে পলাতক। টিকটক হৃদয় মামলার ১২ নম্বর আসামি। তার বিষয়ে কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয়রা বলছেন, এরা এলাকায় চিহ্নিত মাদক কারবারি হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় আইনে ফাঁকফোকর দিয়ে মুক্ত হয়ে যায়। বারবার এ ধরনের সুযোগ পাওয়ার ফলে এরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো সংবাদ