বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:২৬ অপরাহ্ন

রাজনৈতিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে

রাজনৈতিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে

জয়ন্ত ঘোষাল:

বাংলাদেশ, গণভবন, ঢাকা। ১৮ আগস্ট ২০২০। সূর্য তখন অস্তপাটে। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। প্রধান ফটক খুলে দিলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। গাড়ি থেকে নামলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শুরু হলো বৈঠক। এক ঘণ্টা ১৫ মিনিটের নিবিড় বৈঠক। শ্রিংলার সঙ্গে ছিলেন বর্তমান হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস। বৈঠকের শুরুতে হাসিনা জানতে চাইলেন, কেমন আছেন নরেন্দ্র মোদিজি। এই করোনা পরিস্থিতিতে আশা করি তিনি সুস্থ আছেন! একেবারেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু এই অরাজনৈতিক উৎকণ্ঠা প্রকাশ প্রথমেই বৈঠকের আন্তরিকতার সুরটা বেঁধে দিল। এরপর হাসিনা জানতে চান প্রণববাবুর কথা। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এখনো তিনি সেনা হাসপাতালে কোমাচ্ছন্ন। শেখ হাসিনা জানতে চান কেমন আছেন তিনি? বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা শুধু নন, সাধারণ মানুষের কাছেও প্রণববাবু খুবই জনপ্রিয় এবং প্রণম্য ব্যক্তিত্ব। শ্রিংলা বললেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুবই সুস্থ আছেন। ফিট অ্যান্ড ফাইন।’ প্রণববাবু সম্পর্কেও তিনি জানালেন যে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি চিকিৎসাধীন। আমরা সবাই আশাবাদী। তাঁর সুস্থতা কামনা করছি।’

তাই বলা যায়, খুবই ঘরোয়া পরিবেশে আলোচনা এগোতে থাকে। সন্ত্রাসবাদ, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উন্নয়ন, নানা ধরনের বিষয়। তবে দুই দেশের মধ্যে আবার রেল চলাচল শুরু করার বিষয়টি ভারত এবার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশে ফেরার পর শ্রিংলা প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে যে রিপোর্ট করেছেন তাতেও দুই দেশের মধ্যে বৈধ কানেকটিভিটিকে (legal connectivity) বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করছেন এই পরিকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।

১৯৬৫ সালের আগ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কিছু রেল যোগাযোগ ছিল, কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর এই রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভারত এবার সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ছয়টি রেল চালু করতে হবে, এর মধ্যে আপাতত চারটি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। ২০২০ সালের মধ্যেই এ প্রকল্প চালু করার কথা ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে করোনা মহামারির কারণে এই ট্রেন চলাচল শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই বৈঠকে ঠিক হয়েছে খুব শিগগির দুই দেশের পরিবহন ও রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক হবে ও শুরু হবে এই রেল যোগাযোগ। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, শুধু ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে নয়, বাংলাদেশের মধ্যেও দশম রেললাইনটি ভারতই নির্মাণ করে দেবে।

এই দুই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ পুরনো। তাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আগে থেকেই এই ভূখণ্ডের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মূলত সেটি ছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আসলে রাজনৈতিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময় ষাটের দশক পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট বাণিজ্যের ভারতীয় অংশ ছিল শতকরা ২৩ ভাগ। পরবর্তী সময়ে এই ধারা হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৬৫-৬৬ সালে বাণিজ্যে ভারতীয় অংশীদারি ছিল ২.৭৪ শতাংশ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান-ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যায়। এতে কিন্তু আর্থিক লোকসান বেশি হয় পূর্ব পাকিস্তানের। কারণ ভারত-পাকিস্তানের মোট বাণিজ্যের গড়ে প্রতিবছর শতকরা ৭৪.৫৭ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। ভারতে পাকিস্তানের মোট রপ্তানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল শতকরা ৮৪.৮৩ ভাগ।

আজ এত বছর পর ১৯৬৫ সালের আগের রেল যোগাযোগ আবার সত্যি সত্যি চালু হতে চলেছে, এ তো কম কথা নয়। ঢাকা-কুড়িগ্রাম ইন্টারসিটি ট্রেনের উদ্বোধন করতে গিয়েও শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবার তা চালু হচ্ছে। এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন উদ্দীপনা লাভ করছে। ২০০৮ সালে কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়। ২০১৭ সালে বন্ধন এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে খুলনায় চালু হয়। বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী এবং ভারতের হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস চিলাহাটি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া রেলপথ পুনরুদ্ধারের কর্মসূচির শুভ সূচনা করেন।

১৯৬৫ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিংয়ে ট্রেন যেত। হলদিবাড়ি স্টেশন পর্যন্ত এই রেলপথকে ভারত সরকার পুনঃস্থাপন করছে। অতএব চারটি রেল চালু হওয়ার পর অন্য দুটি করিমগঞ্জ-মহিশাসন থেকে বাংলাদেশের শাহবাজপুর এবং হলদিবাড়ি-চিলাহাটিও চালু হবে। সমুদ্রপথে মোংলা বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর যোগাযোগ স্থাপন হবে। এলপিজি গ্যাস অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসবে। তাতে বাংলাদেশ প্রভূত রাজস্ব সংগ্রহ করবে। কারণ এ জন্য ট্রানজিট চার্জ পাবে বাংলাদেশ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন এই করোনা আক্রান্ত সময়ে কেন পররাষ্ট্রসচিব হঠাৎ ঢাকা গেলেন? বাংলাদেশ ও ঢাকার সংবাদমাধ্যমের একাংশ প্রচার করছে, চীনের আগ্রাসী মনোভাবের জন্যই বিদেশসচিবের এই তড়িঘড়ি সফর। কোনো সন্দেহ নেই পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। কিন্তু পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফরের পেছনেও আছে এক নেপথ্য কাহিনি।

গত ছয় মাস করোনার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিব পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যেতে পারছেন না। শুধুই ভিডিও কনফারেন্স হচ্ছে। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবীরই এমন হাল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসবভনে বিদেশি অভ্যাগতদের আসাও তো বহুদিন বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় ভারত সরকারের প্রত্যাশা ২০২০-এর ডিসেম্বরের মধ্যেই করোনা মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন এবার ধীরে ধীরে আবার বিদেশ সফর শুরু করুন। ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রই প্রথম’—এই নীতি মেনে শ্রিংলা বাংলাদেশ থেকেই তাঁর সফর শুরু করলেন। বাংলাদেশের পর হয়তো তিনি যাবেন মিয়ানমার। সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ সফর হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনা ভারতের হস্তক্ষেপ চান। ভারত এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। নিরাপদ কোনো যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে তাদের কিভাবে ফেরত পাঠানো যায় সেটাই ভারতের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও কাজে লাগাতে চাইছে ভারত। জাতিসংঘের বৈঠকও আসন্ন, আর এবার নিরাপত্তা পরিষদে ভারত আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পেতে পারে।

গত মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদির যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। এখন নতুন পরিকল্পনা, আগামী বছর বাংলাদেশ গঠনের ৫০ বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে মোদি ঢাকা যাবেন ২০২১ সালে। তারপর শেখ হাসিনাও আসবেন দিল্লি। শেখ হাসিনা-পররাষ্ট্রসচিব বৈঠকে এ ব্যাপারেও চূড়ান্ত কথা হয়ে গেছে। তবে চীনের ঢাকাকে সাহায্য প্রদান নিয়ে দিল্লির মোদি সরকার ও হাসিনা সরকার উভয় পক্ষই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ চীন যে ঋণ দেয় তা শুনতে অনেক, কিন্তু এই ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়া খুবই জটিল। আর চীন বরাবরই যতটা ঘোষণা করে, ততটা অর্থ কখনোই দেয় না। ফলে ‘ঢক্কা নিনাদ’ হয় বেশি। বাংলাদেশকে যেমন ২৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আসলে এখন পর্যন্ত দিয়েছে শুধু এক বিলিয়ন ডলার। সেখানে ভারত বলেছে দেবে ৭.৮ বিলিয়ন, আর এরই মধ্যে দিয়ে দিয়েছে ৮০০ মিলিয়ন। জিয়ার আমলে চীন বলেছিল ৭৭ হাজার ৬৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দেবে। তখনো বাংলাদেশ আদতে পেয়েছিল ৯ ভাগের এক ভাগ মাত্র। কিন্তু গণমাধ্যমে তখনো পাকিস্তান-চীন ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্যের কথা বলেছিল। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে।

লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877