শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ভয়াবহ বেপরোয়া রূপে কিশোর গ্যাং কালচার

ভয়াবহ বেপরোয়া রূপে কিশোর গ্যাং কালচার

স্বদেশ ডেস্ক:

করোনাকালীন নানামুখী চাপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারির সুযোগে দেশজুড়ে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘কিশোর গ্যাং’। উদ্ভট সব নামে এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলছে তারা। এরই মধ্যে এদের সংশ্লিষ্টতায় সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতা ভয়াবহ ও বেপরোয়া রূপ নিয়েছে। পাড়া-মহল্লা-বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের ধনীর দুলাল, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এসব বাহিনীতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের হাতে হাতে এখন দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি; রয়েছে অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও।

কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগই মাদকসেবী। ‘হামসে বাড়া কন হে’- এ হিরোইজম ভাব দেখাতে গিয়ে তুচ্ছ ঘটনায় যখন তখন অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে হামলে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। এ ছাড়া ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি, ইভটিজিং, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। রাত বাড়লেই অভিজাত এলাকায় শুরু হয় এদের একাংশের ডিসকো পোলার মোটর ও কার রেসিং। মুঠোফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তারা ব্যবহার করছে অস্ত্র হিসেবে। তথ্য ও ছবি আদান-প্রদানের পাশাপাশি পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে অনলাইনে। নিজেদের শক্তি দেখাতে খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না ভয়ঙ্কর এই অপরাধীরা।

সর্বশেষ গত সোমবার নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ইস্পাহানীঘাট এলাকায় স্থানীয় দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দুই স্কুলছাত্র। ঘটনার দিন বিকালে এক পক্ষের ধাওয়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় স্থানীয় কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্র নিহাদ (১৮) ও বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জিসান (১৫)। মধ্যরাতেই শীতলক্ষ্যায় মেলে তাদের লাশ। নিহাতের চাচা কমল খান বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের কারণে তার ভাতিজাসহ দুই ছাত্রের প্রাণ গেল। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন তিনি।

গত ১৫ মার্চ এক অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক ও কিশোর গ্যাং। প্রত্যেক কিশোরের বাবা-মা আছে। প্রতিটি ঘর থেকে বাবা-মা সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করলে কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি হতো না। মা-বাবার উচিত সন্তান কখন কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে- সব খোঁজখবর রাখা। কিন্তু বর্তমান সমাজের মা-বাবা তাদের সন্তানের খোঁজখবর রাখেন না, যার কারণে কিশোর গ্যাং বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সড়কে এক পথযাত্রীকে অস্ত্র দিয়ে মারধর করে রক্তাক্ত জখম, চুরি ও হুমকির অভিযোগে গত ৩ আগস্ট সহযোগী নাজমুলসহ আলোচিত-সমালোচিত বাংলাদেশি টিকটকার ইয়াসিন আরাফাত অপু ওরফে ‘টিকটক অপু’ ওরফে ‘অপু ভাইকে’ গ্রেপ্তার করে উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ। মারধরের ঘটনায় সে গ্রেপ্তার হলেও টিকটক অপুর বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং তৈরির প্রচেষ্টা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।

মূলত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং কালচারের গোড়াপত্তন হয় অনেক আগেই। দলে দলে ভাগ হয়ে মহল্লাকেন্দ্রিক এবং ভার্চুয়াল জগতে উদ্ভট সব নামে আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে এক একটি গ্রুপের। এই কালচার ভয়াবহতা প্রকাশ্যে আসে রাজধানীর উত্তরায় গড়ে ওঠা একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর খুনের পর। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি এ হত্যাকা-ে জড়িত উত্তরাকেন্দ্রিক ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘বিগ বস’ নামে কিশোর গ্যাংয়ের দলনেতাসহ আটজন গ্রেপ্তারের পর তাদের তথ্যে টনক নড়ে প্রশাসনের। লাগাতার অভিযানে ঢাকায় গজিয়ে ওঠা অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের ৫ শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর গ্যাং সদস্যরা কিছুটা দমলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তলে তলে ঠিকই সক্রিয় থাকে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের পাইওনিয়ার গলিতে কিশোর গ্যাং ‘আতঙ্ক’ গ্রুপের হাতে খুন হয় ‘ফিল্ম ঝিরঝির’ গ্রুপের সদস্য স্কুলছাত্র মহসিন (১৬)। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয় সহপাঠী সাব্বির (১৭) ও রাকিব (১৭)। আবার নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এই খুনের দুই দিন পর কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানার বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে ১১২ কিশোরকে আটক করে পুলিশ। জব্দ করা হয় ছয়টি মোটরসাইকেল। এখন আবার পুরনো চিত্র ফিরেছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে বিরাজমান অস্থিরতায় কিশোর-তরুণদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আর দ্বন্দ্ব থেকেই ঝরছে রক্ত। সামাজিক শিক্ষা না থাকায় কিশোররা এ ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে তারা। মূলত সমাজ এবং পরিবার বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল কিশোররা স্বাভাবিক শৈশব না পেয়ে অপরাধী হয়ে উঠছে। এসব খুনাখুনি বন্ধ করতে পরিবারকে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি অপরিসীম।

পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা আগের তুলনায় এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি মাদক সহজলভ্য না হওয়ায় চুরি-ছিনতাইয়ে নামছে তারা। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশেই গ্যাং কালচারের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি রাজধানীতে। ঢাকায় খুঁজে পাওয়া ৬২টি কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় ৪২টি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য। এদের অধিকাংশ সদস্যেরই বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। মূলত এ গ্যাং কালচারের সদস্যরা কিশোর বলে গণ্য হওয়ায় দ-বিধিতে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের কেউ অপরাধ করলে তাকে দ-বিধিতে কোনো বিচারকার্য সম্পাদন করার বিধান নেই। অপরাধকা- ঘটিয়ে ফেললেও তাদের আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর নিয়ম। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে সমাজের অনেকে। তারাই অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে বিভ্রান্ত কিশোরদের দিয়ে নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম করিয়ে নিচ্ছে। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৯০টিরও বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যকে আইনের আওতায় এনে সংশোধনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাগাতার অভিযানে এখন আর আগের মতো কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা শোনা যায় না। তার পরও পাড়া-মহল্লায় এদের সহযোগীরা গোপনে কার্যক্রম চালাতে পারে- এটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তারা যেন সংগঠিত হতে না পারে সে লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিসহ কিশোর গ্যাংয়ের মূলোৎপাটনে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।

জানা গেছে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে চলতি বছরের ১৭ জুলাই কুমিল্লার চানপুরে রাসেদুল ইসলাম শাওন নামে এক তরুণকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় কয়েক বখাটে। ১৫ জুলাই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসুলপুর ৬ নম্বর গলিতে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে ছুরিকাঘাতে খুন হয় সজিব নামে এক তরুণ। ৭ মে মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগরের দেউলভোগ গরুর হাট এলাকায় একই দ্বন্দ্বের জেরে রবিউল নামে এক মাদ্রাসাছাত্রকে কুপিয়ে খুন করা হয়। ২৩ ফেব্রয়ারি হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় হাসনাত শিপন নামে এক তরুণ। এ ঘটনায় ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আব্দুল বাতেন জানান, হাতিরঝিলে বেগুনবাড়ী ও মধুবাগ এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখানকার উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। মহল্লাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছে শিপন। ১৩ জানুয়ারি সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ভুরভুরিয়া চা-বাগানের ভেতর খুন হয় ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ইব্রাহিম মিয়া রকি। ৪ জানুয়ারি নাটোর সদর উপজেলার হালসা এলাকায় একই দ্বন্দ্বে কুপিয়ে খুন করা হয় আরএসটিইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী কামরুলকে।

গত বছর ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে মুগদায় মান্ডার ল্যাটকার গলি বালুর মাঠে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ মাহিন হোসেন। ১৮ নভেম্বর মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত হয় শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিফাত ও মো. শাহেদ। গত ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করায় কিশোর গ্যাং চক্রের হাতে খুন হয় নূরুল ইসলাম নামে এক কিশোর। ২৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর শেখদি এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ রিফাত হোসেন। ৭ জুলাই বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জেরে দুই গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে শুভ আহমেদ নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। ১৫ মে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ চৌমুহনী পৌরসভায় খুন হন জুহায়ের হোসেন নামে এক কলেজছাত্র। ১২ মার্চ সিলেট শহরের কামারপট্টি গলিতে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের বলি হয় সাব্বির আহমদ নামে এক তরুণ। ৭ মার্চ রাজধানীর চকবাজারের ১৪ নম্বর বকশিবাজার সড়কে ইমনের গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় বক্সার গ্যাং প্রধান সিজান ওরফে বক্সার। এই সময় অর্থাৎ গত এক বছরে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আহত হওয়ার এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক।

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মো. মহিউদ্দিন জানান, বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও ছিনতাই-চাঁদাবাজির পাশাপাশি মারামারি-খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বখাটে কিশোর-তরুণরা। মাদকাসক্ত এসব কিশোরকে ব্যবহার করছেন কতিপয় রাজনৈতিক নেতা। সামাজিক নানা অপকর্মে জড়িত কিশোর-যুবাদের নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা। এলাকাভিত্তিক নেতা ও সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় এসব বখাটের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী।

চট্টগ্রামে পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি তাদের আচরণ সংশোধনেও কাজ করছি। আটক করার পর দেখা গেছে, অনেকেরই সুন্দর শৈশব নেই। আমরা চেষ্টা করছি তারা যেন অপরাধজনক কাজ থেকে ফিরে এসে একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন পায়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877