এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার। এ বাজেট নিয়ে অনেকে নানা রকমের কথাবার্তা বলছেন। এটা বড় বাজেট তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু এ বাজেট কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। যখন বড় বাজেট হয়, তখন আয়ের একটা বড় টার্গেট থাকে। থাকে ব্যয়েরও টার্গেট। আয়ের টার্গেটের বড় সমস্যা হলো জনগণ ও ব্যবসার ওপর কর ও ভ্যাটের বোঝা বেড়ে যাওয়া। গতবার এনবিআরের ওপর যে টার্গেট ছিল, তাতে বিশাল টাকার ঘাটতি ছিল। আর এনবিআরের আদায় বেড়েছে ৭ শতাংশ মাত্র। যেখানে ১৭ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। এনবিআরের আদায় হার যদি দেখা যায়, তা হলে এত বিশাল টাকা এনবিআরের পক্ষে আদায় করা সম্ভব হবে না বলে মনে হয়। কারণ এনবিআরের সামর্থ্য, পদ্ধতিগুলো যে আধুনিকায়ন করেছে বলে মনে করি না।
কারণ এনবিআর পাঁচ-সাত বছর ধরে বলছে, আমরা ডিজিটালাইজেশন করব। জনবল বাড়াব। আয়কর বৃদ্ধি করব। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। এখানে একটা বড় ফাঁক রয়ে গেছে। ব্যয়ের ব্যাপারে বলব, ব্যয় তো সব হয়ে যাবে-বিশেষ করে রাজস্ব ব্যয় হবেই। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রকল্প আছে। আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেগা প্রকল্প আছে। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলো বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। তবু পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলে ভালো হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভালো দক্ষ প্রকল্প পরিচালক পাওয়া যায় না। ফলে কী হচ্ছে-একজন চার-পাঁচটা করে প্রকল্প পরিচালনা করছেন। কিন্তু তারা ভালোভাবে মনিটর করতে পারেন না। অনেকেই ঢাকায় বসে বেশিরভাগ প্রকল্প পরিচালনা করেন। ফলে প্রকল্পের সামর্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয় না। দেখা যাচ্ছে কাজের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হতো কয়েকটা বড় প্রকল্প রেখে বাকি ছোট ছোট প্রকল্প না নেওয়া।
তবে সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ-এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বড় প্রকল্পের দরকার আছে। মে মাসে এসে দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার। দুই মাসে বাকি প্রকল্পের কাজ কি শেষ করতে পারবে। যদিও যেগুলো তাড়াহুড়া করে শেষ করে সেগুলোর মান বজায় থাকবে না। শুধু অর্থের অপচয় হবে। আরও একটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের প্রকল্পের কাজে লাগে সাত বছর। এডিপিতে অনেক অসমাপ্ত প্রকল্প আছে ফলে কী হয়-সময়মতো শেষ করতে না পারায় গুণগত মান বজায় রাখতে পারে না, খরচও বেড়ে যায়।
পদ্মা সেতুর অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, এর খরচ এখন দ্বিগুণ হয়েছে। সঠিক সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বিষয়টা বিবেচনা করতে হবে। ঘাটতি বাজেটের বিশাল একটা অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়-ব্যাংকের অবস্থা তো ভালো নয়। ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেওয়া মানে প্রাইভেট সেক্টর ঋণ পাবে না। প্রাইভেট সেক্টরে যদি বিনিয়োগ না যায়, তা হলে আমাদের দেশে কর্মসংস্থান হবে না। বিশেষ করে কর্মসংস্থান আমাদের দেশে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশাল জনগোষ্ঠী শিক্ষিত যুবক, বেকার যুবক। আমাদের আসলে মূল্য লক্ষ্য কর্মসংস্থান হওয়া উচিত। বাজেটের কতগুলো চ্যালেঞ্জ আছে।
আমি মনে করি, আমরা কিছু অর্জন করেছি। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে এসেছে এবং উন্নয়শীল দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এ দুটি করার জন্য আমাদের প্রবৃদ্ধি ছয়ের বৃত্ত থেকে সাতে চলে এসেছি। তার পর আমরা আটের দিকে যাচ্ছি। এটা ভালো দিক। এগুলোকে যদি অর্জন করা যায়, তা হলে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করার দরকার ছিল, সেগুলো বাজেটে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। সাতচল্লিশ বছর লেগেছে। আমরা আর সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর কালক্ষেপণ করতে পারব না। পৃথিবীর অন্য দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও ব্যক্তিপর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে শুরু করে বিআরসি, বিটিআরসি, বিডা-এগুলো যদি দেখা যায় এদের দক্ষতা ও কর্মদক্ষতা কী রকম অবস্থা। ব্যক্তিপর্যায়ে সরকারি-বেসরকরি কর্মচারীদের দক্ষতা, সততা ও কর্মতৎপরতার যথেষ্ট উন্নয়ন প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যে জনশক্তি রপ্তানি করা হচ্ছে, তাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার এবং তাদের যাওয়ার খরচটা কমানো উচিত। এ বিষয়গুলো বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমাদের দিন দিন প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা একটা সূচক মাত্র। আসলে হলো মানুষের জীবনযাপনের মান। মানুষের আয় ও সম্পদের যে বৈষম্য বাড়ছে, এটা তো কোনোভাবেই কমার লক্ষণ দেখছি না। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কিন্তু আসলে যারা বঞ্চিত, তাদের এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন। যারা বঞ্চিত তাদের কর্মসংস্থান করা দরকার। আর যারা অবহেলিত তাদের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় জিনিস-একজন দরিদ্র ব্যক্তি শিক্ষার মাধ্যমে উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। শিক্ষা অর্জন করলে বেশি সম্পদের দরকার হয় না। জীবন গড়তে সহায়ক হলো শিক্ষা। তাই বলছি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ এই চ্যালেঞ্জগুলো বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া খুবই প্রয়োজন। বাজেট একতরফা হতে পারে না। বাজেটের এক ধরনের ধারাবাহিকতা থাকবে। গত বাজেটে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বঞ্চিত হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এ বাজেটে কাটিয়ে ওঠা উচিত ছিল। কর্মসংস্থান, আয়বৈষম্য, শিক্ষার উন্নতি, স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি করা আরও প্রয়োজন।
এগুলো বেশি বেশি গুরুত্ব দিলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। বাকিগুলো প্রাইভেট সেক্টরের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে উন্নয়নে যে বাধাগুলো আছে, যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা আছে, তা দূর করতে হবে। এই বাজেটে বিশেষ করে যারা মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে, তারাই সুবিধা ভোগ করবে। যারা উচ্চমধ্যবিত্ত তারাই আবার ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে। কিন্তু দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তরা সুফল পাবে না। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে না। সে জন্য এই বাজেট জনকল্যাণমুখী বাজেট বলব না। এ বাজেট অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাজেট হতে পারে। আমাদের দরকার হলো সামাজিক উন্নয়ন- যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা ও আইনশৃঙ্খলার। সে বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পাইনি।
তাই বলব-কল্যাণমুখী যে বাজেট হওয়া উচিত, সেটা হয়নি। এবার শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, এ ব্যয়টার বেশিরভাগ চলে যাবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য। কিন্তু আসলে তো প্রয়োজন শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, স্কুলের মানোন্নয়ন করা। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক থাকেন ছয়-সাতজন, কিন্তু উপস্থিতি দু-তিনজনের বেশি দেখা যায় না। তারা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। স্কুলের ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় রাজনীতির প্রভাব। এ ধারা পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া প্রশাসনের বেতন-ভাতার সুবিধা ও রাষ্ট্রের সুরক্ষায় পুলিশের জন্য এই দুই খাত মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ২৩-২৪ শতাংশ চলে যাচ্ছে। বাজেটের এক-চতুর্থাংশ যদি প্রশাসনে চলে যায়, তা হলে অন্যান্য জনকল্যাণমুখী ও জনবান্ধবের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অবহেলিত হয়। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ শতকরা ৫ ভাগের মতো রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যের মতো একটা বিশাল খাতকে অবহেলা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যে টিকা দেওয়া ও বিশুদ্ধ পানি খাওয়ানো তো আর সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্যসেবা না। গরিরের জন্য তো উন্নততর চিকিৎসাও প্রয়োজন। গরিবেরও তো জটিল রোগ হয়। তাদের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। সরকারি হাসপাতালের অবস্থার কথা আমরা সবাই জানি।
হাসপাতালে দেখা যায়, ১০০ টাকার মধ্যে ৬০ টাকা খরচ হয় রোগীর। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত টাকা খরচ হয় না। গরিবরা এত টাকা কোথা থেকে পাবে। তার মানে স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত। কৃষি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে এত বিশাল জনগোষ্ঠী, সেটিতে নজর দিতে হবে। দেওয়া হয়নি। যেটুকু ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা কিন্তু কৃষকের হাতে সঠিক সময় পৌঁছায় না। এবার কৃষক তাদের ধানের সঠিক দাম পাননি। এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। আমরা যদি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঠিক না করতে পারি, তা হলে বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুরূহ হবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। বলা হচ্ছে কমিশন করবে কিন্তু হচ্ছে না। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে যথাযথ দায়িত্ব দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত শক্ত অবস্থান নেওয়া। এবার বাজেটে যদি নতুনত্ব আসত, তা হলে ভালো হতো। সর্বোপরি এ বাজেটে ভ্যাটের বিরাট একটা বিস্তার হবে। যতই বলা হচ্ছে ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ বিভিন্ন স্তরে আদায় করা হবে। বিভিন্ন স্তরে থেকে স্থানান্তর হয়ে ভোক্তার কাছেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বোঝা চাপবে। মাঝখানে যাদের ভ্যাটগুলো দেওয়ার কথা, তারাই ভোক্তার কাছে স্থানান্তরিত করবে।
কিছু পণ্যের দাম কমবে, কিছু পণ্যের দাম বাড়বে-আসলে এটা বাজেটে হয় না। যার একটা পণ্যের দাম কমে, সে আবার অন্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত বাংলাদেশে যে জিনিসের দাম একবার বাড়ে, তা আর কমে না। তাই বলব, সার্বিকভাবে এ বাজেট জনবান্ধব ও জনকল্যাণমুখী হলে ভালো হতো।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক