শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৬:২১ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
‘বড়’ হয় ঋণখেলাপিরা দায় শেষ তালিকায়

‘বড়’ হয় ঋণখেলাপিরা দায় শেষ তালিকায়

স্বদেশ ডেস্ক : জাতীয় সংসদে শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। উল্টো তাদের জন্য ইতিপূর্বেই সাজানো হয়েছে নানা ধরনের পুরস্কারের ডালি। প্রকৃতপক্ষে শীর্ষ ঋণখেলাপি যারা, বছরের পর বছর তারা ঋণ ফেরত না দিয়েও একদিকে নিজেদের রেখেছেন খেলাপির তালিকার বাইরে অন্যদিকে গ্রহণ করেছেন নানা রকম ‘বিশেষ’ আর্থিক সুবিধাও।

সব মিলিয়ে দেখা গেছে, ঋণখেলাপিরা দিন-দিন ফুলে ফেঁপে ‘বড়’ হচ্ছেন আর সরকার দায় সারছে ¯্রফে তালিকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আবার সেই তালিকাও স্বচ্ছ না, সেখানে কৌশলে রাখা হয়নি শীর্ষ অনেক খেলাপিকে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, কঠোর শাস্তির বিধান না থাকায় ঋণখেলাপিরা অর্থ ফেরত দিচ্ছেন না। উল্টো আদালতের রায় নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেনÑ নতুন করে ঋণ নিচ্ছেন, নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন, অর্থপাচার পর্যন্ত করছেন।

তারা বলছেন, সঙ্গত কারণেই ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে। এ সংক্রান্ত বিচারিক প্রক্রিয়াও দ্রুতসময়ে যেন সম্পন্ন হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফ সুবিধা ভোগকারী যারা, তাদেরও তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

গত শনিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকা তুলে ধরেন। এতে শাহাবুদ্দিন আলমের এসএ গ্রুপ, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার এমএ আজিজ ও এমএ কাদেরের ক্রিসেন্ট গ্রুপ, ইউনুস বাদলের অ্যাননটেক্স গ্রুপ, হেফাজতুর রহমানের মোস্তফা গ্রুপসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে বিক্ষিপ্তভাবে। একই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে মোট কী পরিমাণ ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে, তা তুলে ধরা হয়নি।

এ ছাড়া হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম বলা হলেও অর্থমন্ত্রীর তথ্যে নেই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া বড় বেশকিছু গ্রুপের বা তাদের কোম্পানির নাম। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন সুবিধা ভোগ করে খেলাপি তালিকার বাইরে রয়েছেন। ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ ছিল এমন ১৪টি গ্রুপ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করে নিয়েছে। এ ছাড়া গত চার বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে।

ক্ষমতার আশপাশে থাকা এসব ব্যক্তি বারবার অনৈতিকভাবে সুবিধা ভোগ করছেন অথচ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এসব প্রভাবশালীর নাম তালিকায় আসেনি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয় সরকারের জন্য; বরং তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যা হবে দৃষ্টান্তমূলক। এ ছাড়া প্রভাবশালী যেসব গ্রাহক সুবিধা গ্রহণ করছেন, তাদের তালিকাও প্রকাশ করতে হবে। তারা কী পরিমাণ ঋণ আটকে রেখেছেন, সে তথ্যও জনগণকে জানানোর ওপর জোর দেন এই অর্থনীতিবিদ।

সংসদে প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপি ছিলেন ১ লাখ ১১ হাজার ৯৫৪ জন; তাদের কাছে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের ঋণখেলাপির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জনে এবং তাদের কাছে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়ে হয় ১ লাখ ২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন এবং খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের পাওনা অর্থ ফেরত দেননি, উপরন্তু পুরস্কৃত হয়েছেন।

২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিন বছরে ৩৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ‘বিশেষ ছাড়ে’ পুনতফসিল করা হয়েছে। সুদ মওকুফ করা হয়েছে ২ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। অথচ এই তিন বছরে খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো নগদ আদায় করতে পেরেছে সাকুল্যে মাত্র ১৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপিরা যে পরিমান ঋণ ফেরত দিয়েছেন, তার প্রায় তিনগুণ বেশি আর্থিক সুবিধা ভোগ করেছেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে বিভিন্ন মানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।

উপরন্তু অবলোপনকৃত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার তথ্য এই হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ এবারই প্রথম নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারেরই এর আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সময় শীর্ষ ১০০ ও শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। উল্টো প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়েও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণখেলাপির নাম প্রকাশ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এটা প্রাথমিক একটি উদ্যোগমাত্র। এখানেই থেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। খেলাপিদের বিরুদ্ধে যেহেতু সরকার অবস্থান নিয়েছে, এটির শেষও করতে হবে। এদের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবেও বর্জন করতে হবে। কয়েক বছর ধরে ঋণখেলাপিদের তালিকা জাতীয় সংসদে তুলে ধরছে সরকার। এরও আগে থেকেই খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। অথচ অর্থ আদায় করা হচ্ছে না। ঋণখেলাপিরা একবার সুবিধা গ্রহণের পর ফের খেলাপি হচ্ছেন; ফের সুবিধা গ্রহণ করছেন। আইনে তিনবারের বেশি সুবিধা ভোগের সুযোগ না থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ৯ থেকে ১০ বার পর্যন্ত সুবিধা গ্রহণ করা হচ্ছে। উপরন্তু এসব বিশেষ সুবিধা গ্রহণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ফেরতের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটিও দিচ্ছেন না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালে খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকগুলো। আদায়ের এ হার শতকরা হিসেবে মাত্র ৪ দশমিক ৩৭ ভাগ। অথচ একই সময়ে পুনঃতফসিল সুবিধায় ২৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে এবং সুদ মওকুফ করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা নগদ আদায়ের তুলনায় অনেক বেশি। এর বাইরে আদালতে রিট করে ‘খেলাপি’ তকমার ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন অনেকে। প্রায় দেড় হাজার ঋণখেলাপি ৮০ হাজার কোটি টাকা নিজেদের কাছে আটকে রেখেছেন আইনি মারপ্যাঁচের মাধ্যমে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে আদালতে মামলা করে দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্থ না দেওয়ার মওকা পাচ্ছেন খেলাপিরা। এ জন্য বিচার প্রক্রিয়াও দ্রুত শেষ করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নবগঠিত সরকারের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঋণখেলাপির সংখ্যা আর বাড়বে না। শুধু তা-ই নয়, ঋণখেলাপির সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য একের পর এক পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন তিনি।

প্রথমে অবলোপন নীতিমালা সহজ করা হয়েছে, অর্থ ফেরত না দিয়েও দীর্ঘ সময় যাতে খেলাপি না হতে হয়, সে জন্য নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। সর্বশেষ ঋণখেলাপিদের গণছাড় দিয়ে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করা হয়েছে। বাজেটেও খেলাপিদের ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কীভাবে নেওয়া হবে এবং কবে নাগাদÑ এসব প্রসঙ্গে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস উল ইসলাম বলেন, তালিকা প্রকাশ করায় জানা গেছে কারা ঋণখেলাপি। কিন্তু ঋণখেলাপিরা অনেক দুষ্ট। তাদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে তাই আরও কঠোর হতে হবে। বিমাণ ভ্রমণ, ভিআইপি ও সিআইপি নির্বাচন, তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠানোÑ এমন ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রদান করা বন্ধ করতে হবে। সামাজিকভাবে তাদের হেয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, তবে যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নন, পরিস্থিতির শিকার, তাদের জন্য এক্সিটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তারা খেলাপির তালিকা থেকে বের হতে পারেন এমন সুবিধা এখন না থাকলেও সেটি করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আর এর পরও যারা টাকা ফেরত দেবেন না, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877