বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০১:৩০ পূর্বাহ্ন

বাজেটে বড়লোকের স্বার্থ রক্ষা

বাজেটে বড়লোকের স্বার্থ রক্ষা

মনজুরুল আহসান খান :
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার বৃহত্তম বাজেট পেশ করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তার পরিমাণ নাকি এর চেয়েও বেশি। বাজেটের আকার বড় হলেও এর থেকে বেশি কিছু আশা করার নেই। যে মেগা প্রজেক্টগুলো চালু আছে, তাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, তার নমুনা রূপপুর পাওয়ার প্রজেক্টের বালিশের গল্প থেকেই জানা যায়।

এ ছাড়া রূপপুর পাওয়ার প্লান্টে ভারী যন্ত্রপাতি নেওয়ায় বড় বড় জাহাজের জন্য নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য হাজারকোটি টাকা পানিতে গেছে। উত্তোলিত বালির সামনে বাঁধ না দেওয়ায় বৃষ্টির পানিতে সব বালি আবার নদীতে। অন্যদিকে ড্রেজিং শুরু হয়েছে বাঁধ ছাড়াই। এবারও হাজারকোটি টাকা যাবে পানিতে।

‘কোম্পানিকা মাল দরিয়াকে ঢাল’-এই প্রবাদের বাস্তবায়নের এক ন্যকারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সরকার। দেশে ব্যাংকিং খাতে লুটপাট এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা এবং বেল আউট করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। ব্যাংকিং জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব খোন্দকার ইব্রাহীম বলেছেন, বাজেটের কার্পেটের নিচে খেলাপি ঋণের অপরাধীদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে। শেয়ার কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তার রিপোর্টও সযতেœ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এর কারণ সবার জানা।

জনগণ ভোট দিয়ে এই সরকার নির্বাচিত করেনি। এসব অপরাধীই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। তাদের কাছেই সরকার জিম্মি, শেখ হাসিনাও। এ ধরনের মাফিয়া চক্রের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-। দেশের শিল্প ও কৃষি নিয়ে বাজেটে ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী কিছুটা পরই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। বেশিরভাগ পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাও আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে নতুন এবং শেখ হাসিনার বিনয়। আমার মনে হয়, ব্যক্তিগতভাবে এই ভালো মানুষটি দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়কদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

বাজেটে তিনি জনকল্যাণে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তার কোনোটাই সঠিকভাবে যথাযথ স্থানে পৌঁছে না। দারিদ্র্য ভাতা, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ১০ টাকা কেজি দরে চাল-কোনোটাই ঠিক ঠিকমতো বিতরণ হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও লুটে নিচ্ছে। আমার সঙ্গে যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, সাতচল্লিশ বছর পার হয়ে গেলেও তাদের পরিবার কোনো রকম ভাতা সহায়তা পাচ্ছে না। শিল্প, কৃষি নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে বটে কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। শতাধিক রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।

আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। এসব এলাকায় সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হবে, অর্থ নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের কতটুকু লাভ হবে! বিদেশি পণ্যে বাজার ছেয়ে গেছে। আমাদের দেশি শিল্পপণ্য বাজারে টিকতে পারছে না। কৃষক আজ দিশেহারা। ধানের মূল্য না পেয়ে তার মনের আগুন দিয়ে ধানক্ষেত জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি মহল এ নিয়ে পরিহাস করছে।

নিজের ও পরিবারের শ্রমের মূল্য বাদ দিয়ে এক মণ ধান ফলাতে কৃষকের যেখানে লাগে এক হাজার টাকা, সেখানে কৃষক দাম পাচ্ছেন মাত্র ৫০০ টাকা। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বটে, তবে তা শহরের মানুষ জানতে পারেনি। বেশিরভাগ মিডিয়া কৃষকদের সুখ-দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামায় না। অনেকেই নানা রকম ছবি দিয়ে বাজিমাত করতে ব্যস্ত। সরকারের টনক নড়েছে অনেক পরে। এখন বেশি দামে ধান কিনবে। কিন্তু ট্যাজেডি এখানে যে, প্রকৃত কৃষকের হাতে এখন ধান নেই। ধান এখন মিল মালিকদের হাতে। তারাই সুবিধাটা পাবে। শিক্ষা নিয়ে সরকার সব সময় বড়াই করে। করতেই পারে।

এখন প্রাথমিক স্তরে লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে। বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। আমাদের পার্শ্ববর্তী সব দেশ, এমনকি অন্ধকারের দেশ আফগানিস্তানের চেয়েও আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম। এটা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।

শ্রমিকদের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, ক্ষেতমজুরদের জন্য সারাবছর কর্মসংস্থান, শ্রমিকদের জন্য পুলিশের মতো রেশনিং, বাসস্থান, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও হেলথ কার্ড বাবদ কোনো অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করা হয়নি। গার্মেন্টস মালিকদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অথচ শ্রমিকদের জন্য কিছু নেই। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ওই বাজেট ধনিকদের জন্য পোয়াবারো, উচ্চবিত্তদের জন্যও উপকারী বটে, তবে নিম্নবিত্তরা চাপে পড়বে। এ কারণে সাধারণ মানুষ বাজেট নিয়ে কোনো আগ্রহবোধ করে না।

যে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তাদের জন্য এবার সামান্যই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এটা আরও অনেক বৃদ্ধি করা দরকার। তাদের অর্থ দেশের শিল্পায়নে ব্যয় করার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা দরকার। পাট খাতে পাকিস্তান আমলের মতো বোনাস ভাউচার স্কিম চালু করা দরকার। এ ছাড়া স্পট থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে এবং বিদেশে বাজারজাতকরণে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। পাকিস্তান আমল থেকে জনগণ দেখে এসেছে, বাজেট বড়লোকের স্বার্থ রক্ষা করে।

এ কারণে তারা বলেন, ‘এটা গরিব মারার বাজেট।’ এসব ব্যাপারে অনেক সহজ করে বোঝাতে পারে শ্রমজীবী মানুষ। সাপ্তাহিক একতায় একজন উবার ড্রাইভারের উদ্ধৃতি দিয়ে বাজেট প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে-‘ওপরে স্যাটেলাইট, নিচে হালুয়াটাইট’। সরদার ফজলুল করিম ঠিকই বলেছেন, জীবন এবং মানুষই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষক।

মনজুরুল আহসান খান : প্রবীণ শ্রমিক ও বামপন্থি নেতা

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877