রোজা
রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। মহান আল্লাহ এ মাসে আমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের মধ্যে যে এই মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন রোজা রাখে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)। রমজানের রোজা এতটাই ফজিলতপূর্ণ যে মহান আল্লাহ এর পুরস্কার নিজ হাতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন যেকোনো নেককাজ যদি আদম সন্তান করে তাহলে তার জন্য ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সাওম (রোজা) ছাড়া, যেহেতু সাওম (রোজা) আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। সাওম (রোজা) পালনকারী আমারই কারণে স্বীয় কামাচার এবং পানাহার পরিত্যাগ করে। সাওম (রোজা) পালনকারীর জন্য সাওম (রোজা) ঢালস্বরূপ। সাওম (রোজা) পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে—তার ইফতারের সময় এবং তার রবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। আর সাওম (রোজা) পালনকারীর (ক্ষুধাজনিত কারণে নির্গত) মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে কস্তুরীর সুগন্ধি থেকেও অধিক পছন্দনীয়। (নাসায়ি, হাদিস : ২২১৫)
শুধু তা-ই নয়, রোজার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের পাপমুক্ত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকির প্রত্যাশায় রমজানে রোজা পালন করবে, তার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৮)
জিকির
জিকির মানে হলো, আল্লাহকে স্মরণ করা। যেকোনো ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে স্মরণ করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) উপাস্য নেই; সুতরাং আমার ইবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামাজ কায়েম করো’। (সুরা তাহা, আয়াত : ১৪)। উল্লিখিত আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, বান্দার ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য ও মাগফিরাত অর্জন করা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কি তোমাদের অধিক উত্তম কাজ প্রসঙ্গে জানাব না, যা তোমাদের মনিবের কাছে সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের সম্মানের দিক থেকে সবচেয়ে উঁচু, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান-খয়রাত করার চেয়েও বেশি ভালো এবং তোমাদের শত্রুর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের তোমাদের সংহার করা ও তোমাদের তাদের সংহার করার চাইতেও ভালো? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলার জিকির। মুআজ ইবনে জাবাল (রা.)১ বলেন, আল্লাহ তাআলার শাস্তি হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার জিকিরের তুলনায় অগ্রগণ্য কোনো জিনিস নেই। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৭৭)
দোয়া
আল্লাহর ওপর ঈমান আনার অন্যতম দিক হলো এ কথার ওপর বিশ্বাস করা যে মহান আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি মহাশক্তির অধিকারী। তাঁর ওপর কেউ বিজয়ী হতে পারে না। আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু তাঁর আয়ত্তাধীন। তাই মানুষ নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য, বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তাঁর কাছে যাওয়ার বিকল্প নেই। তিনি মহান আল্লাহ, পরম করুণাময়। তাঁর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি খুশি হন। যেকোনো বান্দা তাঁকে ডাকলে তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দেন। আর যারা তাঁর কাছে দোয়া করে না, তিনি তাদের ওপর রাগান্বিত হন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের রব (আল্লাহ) বলেন, তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা : মুমিন, আয়াত : ৬০)।
এ জন্য পবিত্র রমজান মাসে আমরা বেশি বেশি মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি। বিশেষ করে এই বছর যেহেতু গোটা বিশ্বকে বিপদাপদ ঘিরে রেখেছে, এই বছর আমাদের দোয়ার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। বিশেষ করে ইফতারের সময় আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যয় না করি। কারণ মহান আল্লাহ ইফতারের সময় বান্দার দোয়া কবুল করেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ধরনের লোকের দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. রোজাদার যখন ইফতার করে, ২. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া, ৩. মজলুমের দোয়া। মজলুম ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ মেঘমালার ওপর উঠিয়ে নেন এবং এ জন্য আসমানের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব, যদিও তা কিছুকাল পরে হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)
নামাজ
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো, সময়মতো নামাজ আদায় করা। হজরত আবু আমর শায়বানি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এ বাড়ির মালিক আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ‘যথাসময়ে নামাজ আদায় করা। ইবনে মাসউদ (রা.) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, অতঃপর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে জিহাদ)। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এগুলো তো আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেনই, যদি আমি আরো অধিক জানতে চাইতাম, তাহলে তিনি আমাকে আরো বলতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫২৭)।
পবিত্র রমজান মাসে আমাদের যাতে ফরজ ও তারাবি নামাজে কোনো রকমের অলসতা না হয়, সে ব্যাপারে খুব যত্নবান হতে হবে। পাশাপাশি আমরা নফল নামাজের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে একটি নফল কাজ করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ সম্পাদন করল।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ১৯৬৫)
যেহেতু এই মাসে আমরা সাহরি গ্রহণের জন্য শেষ রাতে উঠেই থাকি, তাই এই মাসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা আমাদের জন্য অনেক সহজ। রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়া মহান আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় একটি আমল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে। এটা তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব (নফল)। অচিরেই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯)। তাহাজ্জুদ নামাজ কুপ্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ নামাজ মন ও মননকে নির্মল করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য অধিক কার্যকর। ওই সময়ে পাঠ করা (কোরআন তেলাওয়াত বা জিকির) একেবারে যথার্থ।’ (সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৬)
অন্যত্র এসেছে, ‘(আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা) যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬৪)। অতএব পবিত্র মাহে রমজানে রাত জেগে নফল নামাজ পড়ার মাধ্যমেও আমরা মহান আল্লাহর প্রিয় হতে পারি।
কোরআন তিলাওয়াত
যেহেতু এটি কোরআনের মাস। তাই এ মাসে আমরা বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতে পারি। রাসুল (সা.) পবিত্র মাহে রমজানে কোরআন পাঠের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন। বিভিন্ন হাদিসের বর্ণনা মতে পাওয়া যায়, জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং কোরআন শিক্ষা দিতেন। (নাসায়ি, হাদিস : ২০৯৫) । তা ছাড়া যারা অধিক কোরআন তিলাওয়াত করে পবিত্র কোরআন কিয়ামতের দিন তাদের সুপারিশ করবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন পাঠ করো। কারণ কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্য সে সুপারিশকারী হিসেবে আসবে। তোমরা দুটি উজ্জ্বল সুরা অর্থাৎ সুরা আল বাকারা এবং সুরা আলে ইমরান পড়ো। কিয়ামতের দিন এ দুটি সুরা এমনভাবে আসবে যেন তা দুই খণ্ড মেঘ অথবা দুটি ছায়াদানকারী অথবা দুই ঝাঁক উড়ন্ত পাখি যা তার পাঠকারীর পক্ষ হয়ে কথা বলবে। আর তোমরা সুরা আল বাকারা পাঠ করো। এ সুরাটিকে গ্রহণ করা বারাকাতের কাজ এবং পরিত্যাগ করা পরিতাপের কাজ। আর বাতিলের অনুসারীরা এর মোকাবেলা করতে পারে না। হাদিসটির বর্ণনাকারী আবু মুআবিয়া বলেছেন, আমি জানতে পেরেছি যে বাতিলের অনুসারী বলে জাদুকরদের বলা হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৫৯)
তা ছাড়া মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতকারীদের জন্য জান্নাতে রেখেছেন বিশেষ সম্মাননা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, (কিয়ামতে) কোরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কোরআন পাঠ করতে করতে ওপরে উঠতে থাকো। তুমি দুনিয়াতে যেভাবে ধীরেসুস্থে পাঠ করতে সেভাবে পাঠ করো। কেননা তোমার তিলাওয়াতের শেষ আয়াতেই (জান্নাতে) তোমার বাসস্থান হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৬৪)।
সুবহানাল্লাহ! আমাদের সবার উচিত পবিত্র এই মাসে যথাসম্ভব বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা।
জাকাত
জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে জাকাত প্রদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনন্য প্রতিষ্ঠান। জাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি; অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
জাকাত সম্পদ পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য মোচন করে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। যেহেতু রমজান মাসে প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান বহু গুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, এ জন্য বেশির ভাগ মানুষ এ মাসেই জাকাত প্রদান করে থাকেন। আমার প্রিয় নবী (সা.)-ও এই মাসেই অধিক জাকাত প্রদান করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) লোকদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল ছিলেন আর রমজান মাসে যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো অধিক দানশীল হয়ে যেতেন। জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁকে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে যখন জিবরাইল (আ.) দেখা করতেন, তখন তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠানো বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। (বুখারি, হাদিস : ৩২২০)
তাই যাঁদের ওপর জাকাত ফরজ, তাঁরা এই মাসে সঠিকভাবে তাঁদের জাকাত আদায় করতে পারেন। বিশেষ করে এই বছর করোনা মহামারির কারণে বহু মানুষ অর্থকষ্টে ভুগছে, সুষ্ঠুভাবে জাকাত বণ্টনের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। মহান আল্লাহ আমাদের নিশ্চয়ই এর উত্তম প্রতিদান দেবেন।
সদকা
যাদের ওপর জাকাত ফরজ নয়, তারা এই মাসে বেশি বেশি সদকা করতে পারেন। যাদের ওপর জাকাত ফরজ, তারাও জাকাত আদায়ের পর অতিরিক্ত সদকা করতে পারেন। সদকার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রিজিকে বরকত এনে দেন। বিপদাপদ দূর করে দেন। মানুষের হায়াতে বরকত হয়, অপমৃত্যু কমে ও অহংকার-অহমিকা থেকে মুক্ত থাকা যায়। (আত্তারগিব ওয়াত তারহিব : ২/৬৫)
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদুল আজহা অথবা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, হে মহিলা সমাজ! তোমরা সদকা করতে থাকো। কারণ আমি দেখেছি, জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই বেশি। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, তোমরা বেশি পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাকো আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও। (বুখারি, হাদিস : ৩০৪)
শুধু বিপদাপদ নয়, সদকার মাধ্যমে গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া যায়। অন্তরের নিফাক দূর হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করুন, (নেকির পথে) তাদের এগিয়ে দিন এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করুন। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৩)।
যারা গোপনে দান করবেন মহান আল্লাহ কঠিন কিয়ামতের দিন তাদের আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)
তা ছাড়া রিজিকে বরকত এনে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিজিক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না। যাতে আল্লাহ তাদের কাজের প্রতিফল পরিপূর্ণ দেন এবং তিনি নিজ অনুগ্রহে তাদের আরো বেশি দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম গুণগ্রাহী।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৯-৩০)
আসুন! পবিত্র রমজানে আমরা বেশি বেশি সদকা করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি।
আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা
ইসলামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ আত্মীয়স্বজনের অধিকারের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সতর্ক থাকো রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়দের ব্যাপারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের পর্যবেক্ষক।’ (সুরা : নিসা, আয়াত-১)
রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে। (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৮)। যারা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না, মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘জ্ঞাতিবন্ধন আরশে ঝুলন্ত আছে এবং সে বলছে, যে আমাকে অবিচ্ছিন্ন রাখবে, আল্লাহ তার সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন রাখবেন। আর যে আমাকে বিচ্ছিন্ন করবে, আল্লাহ তার সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করবেন।’ (রিয়াদুস সালেহিন, হাদিস : ৩২৮)
আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্কের পুরস্কার মহান আল্লাহ দুনিয়াতেও দেন। তা হলো রিজিকের প্রশস্ততা। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে। (বুখারি, হাদিস : ২০৬৭)
তাই আমাদের উচিত পবিত্র মাহে রমজানে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। তাদের কোনো অভাব অনটন আছে কি না সেই খোঁজ রাখা। বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো। হয়তো এর অসিলায় মহান আল্লাহ আমাদের জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন।
লাইলাতুল কদরের ইবাদত
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত লাইলাতুল কদর। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি রাত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি নাজিল করেছি এই কোরআন মহিমান্বিত রাতে। আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত। (সুরা আল কদর, আয়াত : ১-৫)
রাসুল (সা.) রমজানে এই রাতের সন্ধানে থাকতেন। তবে রমজানের শেষ দশকে তিনি ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন। এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৪)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো। (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)। উল্লিখিত হাদিসগুলো দ্বারা বোঝা যায়, পবিত্র মাহে রমজানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, লাইলাতুল কদরের সন্ধানে থাকা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তার পেছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা পালন করবে, তারও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে। (বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
ইতিকাফ
রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত হলো ইতিকাফ। বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্য সব কিছু থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়।
ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস ইতিকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৫)।
তিনি রমজান মাসের ইতিকাফকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো তা ছাড়েননি। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৬)
রমজানে ওমরাহ
রমজান মাসের ফজিলতপূর্ণ আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি আমল হলো, রমজান মাসে ওমরাহ করা। কেননা হজ ওমরাহ মানুষের দরিদ্রতা ও গুনাহ দূর করে দেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ধারাবাহিক হজ ও ওমরাহ আদায় করতে থাকো। এ দুটি আমল দারিদ্র্য ও গুনাহ বিদূরিত করে দেয়। যেমন, ভাটার আগুনে লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা-জং দূরীভূত হয়ে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮১০)
তাই সামর্থ্য ও সুযোগ থাকলে আমরা পবিত্র রমজান মাসে ওমরাহ পালন করতে পারি। এতে করে মহান আল্লাহ আমাদের গুনাহ যেমন ক্ষমা করবেন, তেমনি এর বিনিময়ে আমাদের হজের সাওয়াব দান করবেন।
পবিত্র রমজান মাসে ওমরাহ পালন করলে হজের সমতুল্য সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এক আনসারি নারীকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে হজ করতে তোমার বাধা কিসের?’ ইবনে আব্বাস (রা.) নারীর নাম বলেছিলেন; কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছি। ওই নারী বলল, ‘আমাদের একটি পানি বহনকারী উট ছিল; কিন্তু তাতে অমুকের পিতা ও তার পুত্র (অর্থাৎ মহিলার স্বামী ও ছেলে) আরোহণ করে চলে গেছেন। আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন পানি বহনকারী আরেকটি উট, যার দ্বারা আমরা পানি বহন করে থাকি।’ নবী (সা.) বলেন, ‘আচ্ছা, রমজান এলে তখন ওমরাহ করে নিয়ো। কেননা রমজানের একটি ওমরাহ একটি হজের সমতুল্য।’ (বুখারি, হাদিস : ১৭৮২)