হজরত আয়েশা (রা.)
একজন অসাধারণ মুসলিম নারী ব্যক্তিত্ব। বাল্যকালেই তাঁর মাঝে ছিল মহত্ত্ব, বড়ত্ব ও সৌভাগ্যের আভাস। তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম মেধাবী নারী। রহমাতুললিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সহধর্মিণী। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সর্বাধিক প্রিয় নারী। আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জাতুস সালাসিল যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। আমর (রা.) বলেন, ‘আমি তাঁর নিকট এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার নিকট কোন লোক সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, আয়েশা (রা.)। আমি বললাম, পুরুষদের মাঝে কে? তিনি বললেন, তাঁর বাবা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৮৫)
ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাস, সাহিত্য, চিকিৎসায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। ইতিহাস ও সাহিত্যের শিক্ষা তো স্বয়ং বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। মুসা ইবনে আবু তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আয়েশা (রা.)-এর তুলনায় বেশি বিশুদ্ধভাষী আমি আর কাউকে দেখিনি।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৮৪)। আর চিকিৎসাবিদ্যা রপ্ত করেছিলেন দিগদিগন্ত থেকে রাসুল (সা.)-এর দরবারে আগত আরব গোত্রের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে। তা ছাড়া শেষ বয়সে রাসুল (সা.) প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। এ কারণে আরবের বিজ্ঞ হাকিম ও চিকিৎসকদের গমনাগমন চলতে থাকত। তাঁরা যখন যে ওষুধ বাতলে দিতেন, আয়েশা (রা.) সেগুলো শিখে নিতেন। উরওয়া (রহ.) বলেন, ‘আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়েশা (রা.) অপেক্ষা দক্ষ মানুষ দেখিনি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, খালা! আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন?’ তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি।’ (সিয়ারু আলামুন নুবালা : ২/১৮২)
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন প্রাণপ্রিয় পরম শ্রদ্ধেয় জীবনসঙ্গীর মোবারক সান্নিধ্য থেকে। রাসুল (সা.)-এর তালিম ও ইরশাদের যাবতীয় মজলিস অনুষ্ঠিত হতো মসজিদে নববীতে, যা তাঁর ঘরের সঙ্গে লাগানো। এ জন্য রাসুল (সা.) ঘরের বাইরেও সাহাবায়ে কেরামকে যা শিক্ষা দিতেন, হজরত আয়েশা (রা.) সেগুলোতে শরিক থাকতেন। দূরত্বের কারণে কোনো কথা বুঝতে অসুবিধা হলে পরবর্তী সময়ে তা রাসুল (সা.) থেকে বুঝে নিতেন। কখনো উঠে মসজিদের কাছে চলে যেতেন। নবী (সা.)-এর বহু হাদিস আয়েশা (রা.)-এর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছেছে। তাঁর প্রখর স্মরণশক্তি এ কাজে সহায়ক হয়েছিল। আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের কাছে কোনো হাদিসের অর্থ বোঝা কষ্টসাধ্য হলে আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করে তাঁর কাছে এর সঠিক জ্ঞাত লাভ করেছি।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৮৩)
তিনি ছিলেন উচ্চ মনোবলসম্পন্ন একজন নারী। তাঁর পবিত্র হৃদয় ছিল তেজস্বিতায় দীপ্ত, সাহসিকতায় ভরা। তিনিই রাসুল (সা.)-এর কাছে জিহাদে অংশগ্রহণ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। যদিও রাসুল (সা.) তাঁকে জিহাদের অনুমতি দেননি। বরং বলেছিলেন হজই নারীদের জিহাদ। এর আগে যখন পর্দার বিধান ছিল না, তিনি বেশ কিছু বিজয়াভিযানে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি বদরের যুদ্ধেও ছিলেন। ওহুদ যুদ্ধে যখন মুসলিম সৈন্যরা প্রায় পর্যুদস্ত, বীর লড়াকুদের পদও যখন টলমল, এমন ঝুঁকির মুখেও হজরত আয়েশা (রা.) দৌড়ে দৌড়ে আহত সৈনিকদের পানি পান করাচ্ছিলেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহুদ যুদ্ধের একসময়ে সাহাবারা নবী (সা.) থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। তখন আবু তালহা (রা.) ঢাল হাতে নিয়ে নবী (সা.)-এর সামনে প্রাচীরের মতো দৃঢ় হয়ে দাঁড়ালেন। আবু তালহা (রা.) সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। একনাগাড়ে তীর ছুড়তে থাকায় তাঁর হাতে ওই দিন দুই বা তিনটি ধনুক ভেঙে যায়। ওই সময় তীরভর্তি তীরাধার নিয়ে যে কেউ তাঁর নিকট দিয়ে যেত নবী (সা.) তাকেই বলতেন, তোমরা তীরগুলো আবু তালহার জন্য রেখে দাও। একসময় নবী (সা.) মাথা উঁচু করে শত্রুদের অবস্থা দেখতে চাইলে আবু তালহা (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি মাথা উঁচু করবেন না। হয়তো শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর এসে আপনার গায়ে লাগতে পারে। আমার বক্ষ আপনাকে রক্ষার জন্য ঢালস্বরূপ।’ আনাস (রা.) বলেন, ‘ওই দিন আমি আবু বকর (রা.)-এর কন্যা আয়েশা (রা.)-কে এবং (আমার মাতা) উম্মে সুলাইমকে দেখতে পেলাম যে তাঁরা পরনের কাপড় এতটুকু পরিমাণ উঠিয়েছেন যে তাঁদের পায়ের গহনা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁরা পানির মশক ভরে নিজেদের পিঠে বহন করে এনে আহতদের মুখে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। পুনরায় ফিরে গিয়ে পানি ভরে নিয়ে আহতদের পান করাচ্ছিলেন। ওই সময় আবু তালহা (রা.)-এর হাত থেকে (তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে) তাঁর তরবারিটি দুইবার অথবা তিনবার পড়ে গিয়েছিল।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৮১১)। এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, হজরত আয়েশা (রা.) কঠিন বিপদের মুহূর্তে উম্মাহর পাশে থেকেছেন। তাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।
পরিখার যুদ্ধে মুসলিমরা যখন অবরুদ্ধ, তখনো তিনি দুর্গ থেকে বের হয়ে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। (সীরাতে আয়েশা (রা.), পৃ. ১৮৫)
ফাতেমা (রা.)
নারীকুল শিরোমণি হজরত ফাতেমা (রা.) বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা, আদরের দুলালী, কলিজার টুকরা এবং সৈয়দ বংশের উৎসধারা। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীনের চতুর্থ খলিফা শের-ই-খোদা হজরত আলী (রা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। প্রিয় নবীর নয়নমণি, জান্নাতি যুবকদের সরদার হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.)-এর মমতাময়ী মা। শারীরিক গঠন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে রাসুল (রা.) ও তাঁর ভীষণ মিল ছিল। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে শারীরিক গঠন, চালচলন, চরিত্র, (বর্ণনাকারী হাসানের মতে) আলাপচারিতা ও কথাবার্তায় ফাতেমা (রা.)-এর চাইতে এতখানি মিল আর কাউকে আমি দেখিনি।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২১৭)
হজরত ফাতেমা (রা.) ছিলেন জান্নাতের নারীদের সরদার। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.)-এর চলার ভঙ্গিতে চলতে চলতে ফাতেমা (রা.) আমাদের নিকট আগমন করলেন। তাঁকে দেখে নবী (সা.) বললেন, আমার স্নেহের কন্যাকে মোবারকবাদ। অতঃপর তাঁকে তাঁর ডান পাশে বা বাঁ পাশে বসালেন এবং তাঁর সঙ্গে চুপিচুপি কথা বললেন। তখন ফাতিমা (রা.) কেঁদে দিলেন। আমি [আয়েশা (রা.) তাঁকে বললাম] কাঁদছেন কেন? নবী (সা.) পুনরায় চুপিচুপি তার সঙ্গে কথা বললেন। ফাতিমা (রা.) এবার হেসে উঠলেন। আমি [আয়েশা (রা.)] বললাম, আজকের মতো দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ ও খুশি আমি আর কখনো দেখিনি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি (সা.) কী বলেছিলেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর গোপন কথাকে প্রকাশ করব না।’ শেষে নবী (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ার পর আমি তাঁকে (আবার) জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী বলেছিলেন?
[আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত] তিনি বললেন, ‘তিনি (সা.) প্রথমবার আমাকে বলেছিলেন, জিবরাঈল (আ.) প্রতিবছর একবার আমার সঙ্গে কোরআন পাঠ করতেন, এ বছর দুইবার পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায়বেলা উপস্থিত এবং অতঃপর আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। অতঃপর বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে জান্নাতবাসী নারীদের অথবা মুমিন নারীদের তুমি সরদার হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৬২৩-৩৬২৪)
রাসুল (সা.)-এর আদরের দুলালী হজরত ফাতেমা (রা.) কঠিন যুদ্ধের ময়দানে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। আবু হাযিম থেকে বর্ণিত, ‘যখন আমার এবং সাহল ইবনে সাআদ আস-সাঈদি (রা.)-এর মাঝখানে কেউ ছিল না, তখন লোকে তাঁর কাছে আরজ করল, (ওহুদ যুদ্ধে) কী দিয়ে নবী (সা.)-এর জখমের চিকিৎসা করা হয়েছিল? তখন তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার চেয়ে অধিক জানে এমন কেউ জীবিত নেই। আলী (রা.) তাঁর ঢালে করে পানি আনছিলেন আর ফাতেমা (রা.) তাঁর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত ধুয়ে দিলেন। অবশেষে চাটাই পুড়িয়ে (তার ছাই) তাঁর ক্ষতস্থানে দেওয়া হলো। (বুখারি, হাদিস : ২৪৩)। এই হাদিস দ্বারা আমরা জানতে পারি যে জাতির কঠিন সংকটময় মুহূর্তে তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী-কন্যা পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনে হাজির হয়েছিলেন।’
রুফাইদা (রা.)
তিনি ছিলেন খাজরাজ গোত্রের শাখা আসলাম গোত্রের সন্তান। তাই তাঁকে রুফাইদা আল আসলামিয়া (রা.) নামেই সবাই চিনতেন। মদিনায় রাসুল (সা.) ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলে সর্বপ্রথম যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে অনেক যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা মুসলিম সেবিকা হিসেবে স্বীকৃত একজন ইসলামী চিকিৎসক। তিনি মূলত তাঁর চিকিৎসক বাবা সাদ আল-আসলামীর কাছ থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এতই ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন যে রাসুল (সা.) যুদ্ধে আহত সব সৈনিককে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য পাঠাতেন। তিনি আহতদের সেবায় মসজিদে একটি তাঁবু করেছিলেন। তাঁর দায়িত্বাধীন সেই অস্থায়ী হাসপাতালকে বলা হতো খিমাতু রুফাইদা। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, খন্দকের যুদ্ধের দিন সাআদ (রা.)-এর চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এবং তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে রুফাইদা নামক এক মহিলার কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি আহতের চিকিৎসা করতেন। নবী (সা.) সকাল-সন্ধ্যায় সাআদ (রা.)-এর কাছ দিয়ে যেতে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার দিন কেমন কাটল, তোমার রাত কেমন কাটল? তিনি তাঁকে (নিজ অবস্থা) অবহিত করতেন। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১৩৯)
আজকের পৃথিবীর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও চিকিৎসার ধারণাটি এখান থেকেই মানুষ নিয়েছে। (এডি জাব্বার, ইউনে হিসতোরিয়ে, পৃষ্ঠা : ৩১৯)
খাইবার যুদ্ধে আহত মুসলিম মুজাহিদদের সুস্থ করতে তিনি মাতৃত্বের মমতাময়ী হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর এই অবিস্মরণীয় ত্যাগ এবং সেবা-শুশ্রূষার স্বীকৃতিস্বরূপ রাসুল (সা.) পুরুষ মুজাহিদদের সঙ্গে তাঁকেও গণিমতের মালের হিস্যা দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বেও তিনি নারী চিকিৎসক ও নার্সদের আইডল হয়ে আছেন। তাঁর সম্মানে বাহরাইনের Royal College of Surgeons in Ireland প্রতিবছর `Rufaida Al-Aslamia Prize in Nursing প্রদান করা হয়। ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক রোগীদের সেবা দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে এই পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। (সৌদি গ্যাজেট)
উম্মে আতিয়্যাহ আল আনসারি (রা.)
মূলত তাঁর নাম ছিল নুসাইবা বিনতে হারেস। কারো কারো মতে, তাঁর নাম ছিল নুসাইবা বিনতে কাআব। উম্মে আতিয়্যাহ ছিল তাঁর উপনাম। তিনি এই নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ আনসারি মহিলা সাহাবি। তিনি সেই মহিলা সাহাবি, যাঁকে রাসুল (সা.) তাঁর মৃত কন্যা জয়নব (রা.)-কে গোসল দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উম্মে আতিয়্যাহ আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কন্যা জয়নব (রা.) ইন্তেকাল করলে তিনি আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘তোমরা তাঁকে তিনবার বা পাঁচবার বা প্রয়োজন মনে করলে তার চেয়ে অধিকবার বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও। শেষবারে কর্পূর বা (তিনি বলেছেন) কিছু কর্পূর ব্যবহার করবে। তোমরা শেষ করে আমাকে খবর দাও। আমরা শেষ করার পর তাঁকে জানালাম। তখন তিনি তাঁর চাদরখানি আমাদের দিয়ে বললেন, এটি তাঁর শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে দাও।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৫৩)
রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এই মহীয়সী নারী। তিনি সেখানে যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামদের সেবা করতেন। অর্থাৎ নার্সের দায়িত্ব পালন করতেন। এ ছাড়া তাঁদের মালপত্র ও সাওয়ারির রক্ষণাবেক্ষণ ও তাঁদের খাবার তৈরির কাজও করতেন।
উম্মে আতিয়্যাহ আল আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাঁদের সাওয়ারি ও মালপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পশ্চাতে থাকতাম, তাঁদের খাবার তৈরি করতাম, আহতদের চিকিৎসা করতাম এবং রোগীদের দেখাশোনা করতাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৫৬)
পাশাপাশি নুসাইব বিনতে হারেস (রা.), যাঁকে আমরা উম্মে আতিয়্যাহ (রা.) নামে চিনি, তিনি একাধারে যেমন হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন, তেমনি ফিকহশাস্ত্রেও তাঁর দখল ছিল অতুলনীয়। মুহাম্মদ ইবনে সিরিন, তাঁর বোন হাফসা বিনতে সিরিনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ তাবেয়ি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/৫৩৮)
উম্মে সুলাইম (রা.)
জ্ঞানে-গুণে, প্রজ্ঞায় যেসব মহিলা সাহাবি উম্মতের জন্য ‘পথিকৃৎ’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলেন, উম্মে সুলাইম (রা.) সেসব সম্মানিতার মধ্যে অন্যতম। আল্লামা ইবনে আছির (রা.) তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : তিনি অন্যতম জ্ঞানী মহিলা ছিলেন।
তিনি মিলহান ইবন খালিদ ও মুলাইকা বিনতে মালিকের কন্যা ছিলেন। উম্মে সুলাইম তাঁর ডাকনাম। আসল নাম সম্পর্কে কেউ বলেন, সাহলা, রুমাইলা, মুলাইকা, আর রুমাইসা। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/৫৩০)
সর্বপ্রথম যখন মদিনায় ইসলাম প্রচার শুরু হয় তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজের প্রিয় ছেলে আনাস (রা.)-কে নিযুক্ত করেন রাসুল (সা.)-এর বিশেষ খাদেম হিসেবে।
ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তিনি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ওহুদ, খায়বার এবং হুনাইন ছাড়াও উম্মে সুলাইম (রা.) অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মশক ভরে পানি আনতেন। আহতদের পানি পান করাতেন, ছাতু গুলিয়ে দিতেন, তীর উঠিয়ে দিতেন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মে সুলাইমকে এবং কিছুসংখ্যক আনসার মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। তাঁরা মুজাহিদদের পানি সরবরাহ করতেন এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৩১)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উম্মে সুলাইম (রা.) ও তাঁর সঙ্গের আনসার মহিলাদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা পানি পান করাতেন এবং আহতদের জখমে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। (তিরমিজি, হদিস : ১৫৭৫)
উম্মতের কঠিন বিপদের সময় জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে জান্নাতের খাতায় নাম লিখিয়েছেন এই মহীয়সী নারী।
রুবাইয়ি বিনতে মুআউয়াজ (রা.)
রুবাইয়ি বিনতে মুআউয়াজ (রা.) ছিলেন বিশিষ্ট বদরি সাহাবি মুআউয়াজ ইবনে হারেস (রা.)-এর কন্যা। কেউ কেউ তাঁকে মুআউয়াজ ইবনে আফরা নামেও ডাকতেন। তিনি বদর যুদ্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ মুজাহিদ ছিলেন। যাঁর হাতে ইসলামের অন্যতম শত্রু আবু জাহাল নিহত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর রাসুল (সা.) তাঁর কন্যা রুবাইয়া বিনতে মুআউয়াজকে সান্ত্বনা দিতে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৫০২৮)
রুবাইয়া বিনতে মুআউয়াজ একজন বড় মুহাদ্দিসা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান (রহ.), সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (রহ.)সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ তাবেয়ি। মাসলা-মাসায়েলের দিক থেকেও তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
শুধু তা-ই নয়, তিনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। সেখানে আহত সাহাবায়ে কেরামদের পানি পান করানোর কাজ করতেন। আহত সাহাবায়ে কেরামদের সেবা ও পরিচর্যা করতেন এবং কোনো সাহাবি শহীদ হয়ে গেলে তাঁকে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। একজন নারী হয়েও তিনি কঠিন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তগুলোয় রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সেবা দিতেন।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা (যুদ্ধের ময়দানে) নবী (সা.)-এর সঙ্গে থেকে লোকদের পানি পান করতাম, আহতদের পরিচর্যা করতাম এবং নিহতদের মদিনায় পাঠাতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ২৮৮২)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতাম। তখন আমরা লোকজনকে পানি পান করাতাম, তাঁদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম এবং নিহত ও আহতদের মদিনায় নিয়ে যেতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬৭৯)
ইসলামের সোনালি যুগে এভাবেই নারীরাও উম্মতের দুর্যোগময় মুহূর্তে তাদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তাঁরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন, মুমিন কখনো অন্য মুমিনের বিপদে দূরে সরে যেতে পারেন না। বরং তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মতো দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়। (বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
বর্তমানেও বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা কঠিন সময় পার করছি। এ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন ডাক্তার ও নার্সরা। মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল। মহান আল্লাহ তাঁদের সবার খেদমতকে কবুল করুন। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে মানবসেবা করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন, বর্তমানের সেবকরাও যাতে তেমনিভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন, সেই কামনা করি। মহান আল্লাহ সবাইকে কবুল করুন। নিরাপদে রাখুন। আমিন।