বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ অপরাহ্ন

করোনা সংকটে কাজ হারাচ্ছেন নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশিরা

করোনা সংকটে কাজ হারাচ্ছেন নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশিরা

নিউ ইয়র্ক শহরে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশি। বহু বাংলাদেশি সাম্প্রতিক সময়ে কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রোঙ্কস সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছেন। এর ফলে আশপাশে ঘন সব প্রতিবেশ গড়ে উঠেছে। ভারতীয়, পাকিস্তানিদের পর দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা তুলনামুলকভাবে বেশি নবাগত। এসব নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন কুইন্সভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক সমস্যা বিষয়ক এডভোকেট বদরুন খান। তিনি মার্কিন কংগ্রেসে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছেন। তার সাক্ষাতকারটি প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস। এখানে তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: নিউ ইয়র্কে এখন কি পরিমাণ বাংলাদেশি বসবাস করছেন তার সংখ্যা কি অনুমান করতে পারেন?
উত্তর: এশিয়ান-আমেরিকান ফাউন্ডেশনের সংকলিত তথ্যমতে, নিউ ইয়র্কে বর্তমানে বসবাস করছেন ৬৬,১৯৭ জন বাংলাদেশি।

প্রশ্ন: তার মধ্যে শতকরা কত ভাগ মার্কিন নাগরিক?
উত্তর: নিউ ইয়র্কে বসবাসকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৪ ভাগই (৪৮,৯৮৫ জন) বিদেশে জন্মগ্রহণকারী। শতকরা ৫৩ ভাগ (২৫,৯১৪ জন) বিদেশে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিক। আর শতকরা ২৬ ভাগ (১৭,২১১ জন) যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছেন। সব মিলিয়ে শতকরা ৬৫ ভাগ (৪৩,১২৫ জন) মার্কিন নাগরিক।

প্রশ্ন: নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী বাংলাদেশি সম্প্রদায় বর্তমাসে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটির মুখোমুখি সেটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
উত্তর: বাংলাদেশি সম্প্রদায় যেসব সমস্যা সবচেয়ে বেশি মোকাবিলা করছে তার মধ্যে রয়েছে অভিবাসন, গাদাগাদি করে বসবাস।

প্রশ্ন: নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের ওপর করোনা ভাইরাস মহামারি এবং এ সংক্রান্ত লকডাউন কি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে?
উত্তর: আমার সারাটা জীবন নিউ ইয়র্কে বসবাস করছি। প্রথমত, আমি বড় হয়েছি ম্যানহাটানের লোয়ার ইস্ট সাইডে, যেখানে আমার পিতামাতার মতো বাংলাদেশি অভিবাসীরা এসে বসবাস করতেন। এখন আমি কুইন্স ও ব্রোঙ্কসে ডিস্ট্রিক্ট-১৪ এর কংগ্রেসওম্যান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করছি। আমি ২২ বছর কুইন্সে বসবাস করেছি। কাজ করেছি ব্রোঙ্কসে। করোনা ভাইরাস বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের ওপর বড় আঘাত ফেলেছে। এ বিষয়টি আমি শুরু থেকেই জানি। তবে এমন অবস্থার শিকার শুধু বাংলাদেশিরাই হয়েছেন এমন নয়। এখানে সেবাখাতে যেসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কাজ করেন তারা সবাই আক্রান্ত হয়েছেন।

এখানে বহু বাংলাদেশি ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদেরকে জোর করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা নাটকীয়ভাবে তাদের কর্মঘন্টা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশিরা তৈরি খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, নেইল স্যালুন, আইব্রু-থ্রেডিং, পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক। সবাই টিকে থাকার জন্য ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কর্মীদের ছুটি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশি ক্যাব/উবার/ লিফট চালকদের কোনো কাজ নেই। আবার অনেকে নিজে আক্রান্ত হওয়া ও পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত করার ভয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন।

প্রথমদিকে বাংলাদেশিরা মসজিদে যাচ্ছিলেন। সেখানে বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাবেশ হতো। এতে করোনা ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু এখন, ইসলামিক পন্ডিতদের সতর্কতার পর মানুষ ঘরের ভিতর অবস্থান করছেন।

প্রশ্ন: বহু বাংলাদেশি নিউ ইয়র্ক শহরে ক্যাব চালক অথবা রেস্তোরাঁ চালান। তাদের জন্য কি অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার কোনো বৈচিত্র আছে বলে প্রত্যাশা করেন? অথবা তা কি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে?
উত্তর: ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে আমি লক্ষ্য করেছি যে, বাংলাদেশিরা অন্য পেশার দিকে সরে যেতে শুরু করেছেন। যারা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন অথবা যারা তরুণ বয়সে এখানে এসেছেন এবং দ্রুততার সঙ্গে ইংরেজিকে রপ্ত করেছেন এবং কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন, তারা ছোটখাট উদ্ভট সব কাজ ছেড়ে দেয়া শুরু করেন। কারণ, এতে রয়েছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মঘন্টা এবং অস্থিতিশীল বেতন। তারা স্থিতিশীলতা চান। বিশেষ করে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে এমনটা হয়েছে। যদিও সবার মধ্যে নিজের একটি ব্যবসা পরিচালনার স্বপ্ন থাকে, তবু তা করা সবার পক্ষে অতোটা সহজ নয়।

প্রশ্ন: আমি লক্ষ্য করেছি কিছু বাংলাদেশি নিউ ইয়র্ক সিটিতে পুলিশ অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। এটা কি নতুন করে অবস্থার উন্নয়ন? এটা কিভাবে শুরু হয়েছে?
উত্তর: এই ধারা শুরু হয়েছে ২০০০-এর দশকের শুরুতে। এটা ওই সময়, যখন আমি লক্ষ্য করলাম যে, বাংলাদেশি পুলিশ অফিসাররা, ইংলিশ জানেন না এমন অভিবাসীদের সাহায্য করছেন। অধিক সংখ্যক বাংলাদেশী যখন স্থিতিশীলতা, সুযোগসুবিধা ও পেনশন সহ চাকরি খোঁজা শুরু করলেন এসব ঘটেছে সেই সময়ে। মার্কিন নাগরিকদের মতো নাগরিক দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটার মধ্য দিয়ে তারা যখন আমেরিকান জীবনধারার সঙ্গে আরো বেশি মিশে যাওয়া শুরু করলেন, এটা তখনই ঘটতে শুরু করেছে।

প্রশ্ন: পশ্চিমা খুচরা ক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল করার কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে ধস দেখা দিয়েছে, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব চাপের মুখে। এখানে এই নিউ ইয়র্কে বসবাসকারীরা কি বাংলাদেশে তাদের প্রিয়জনকে সাহায্য করার কোনো চেষ্টা করছেন? দেশের অবস্থা নিয়ে তারা কি বলছেন?
উত্তর: অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক চাপে। সেখানে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জন্য আমাদের বিভিন্ন সংগঠন আছে। তারা কাজ করছে। কিন্তু এখন সময়টা খুব বিরূপ। প্রথমত, নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বিদেশে তাদের প্রিয়জনদের কাছে অর্থ পাঠানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মার্কিন সরকারের এক্ষেত্রে নির্দেশ হলো ঘরেই থাকতে হবে। এটা মানতেই হবে। ফলে তারা ভাবছেন, আমার এখন কাজ নেই। আমার খাদ্যের প্রয়োজন। আমি তো নিজেকেই বাঁচাতে পারছি না। তাহলে কিভাবে বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করবো?

প্রশ্ন: সমাজের একজন কর্মী হিসেবে আপনি বিশেষ করে কোন দিকে দৃষ্টি দেবেন?
উত্তর: এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। যদি আমি কংগ্রেসওমেন নির্বাচিত হই তাহলে আমাকে অনেক অনেক কাজ করতে হবে। আমি দৃষ্টি দিতে চাই স্থায়ী সার্বজনীন মৌলিক আয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাস্তবায়নে দিকে। কারণ, কভিড-১৯ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের জনগণকে কাজ দিতে হবে। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে হবে। আবার যেসব নারী ও ছেলেমেয়ে গৃহসন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে তাদের সাহায্য করতে কাজ করতে চাই। আমি দেখতে পাই স্বাস্থ্যসেবা সুবিধায় রয়েছে বাস্তব সমস্যা এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে আবাসনের সমস্যা।

প্রশ্ন: ভারতীয়রা যেমনটি করেছেন, তেমনই কি আমরা বাংলাদেশীদের এই শহর ছেড়ে যেতে দেখছি?
উত্তর: হা। এরই মধ্যে এই শহর ছেড়ে যেতে শুরু করেছেন বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে রয়েছে লং আইল্যান্ড এবং নিউ জার্সি। সেখানে বাড়িগুলো বেশ বড়। এটাকে বলা হয় আমেরিকান ড্রিম- তারা চান এমন একটি বাড়িতে বসবাস করতে, যেখানে থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, একটি ব্যাকইয়ার্ড- যেখানে বাচ্চারা খেলাধুল করতে পারবে। পরিবারের সদস্যরা মিলে বারবিকিউ করতে পারবে।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন নিউ ইয়র্ক সিটিতে রাজনৈতিক ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করতে পারে নি বাংলাদেশিরা এবং দক্ষিণ এশিয়ার মানুষরা?
উত্তর: আমি মনে করি বাংলাদেশি সম্প্রদায় ও দক্ষিণ এশিয়ানদের মধ্যে প্রচুর সাম্প্রদায়িক গর্ববোধ আছে। তবে গ্রুপ ও ব্যক্তিভেদে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য আছে। এখানে নিউ ইয়র্ক সিটিতে বহু ছোট ছোট বাংলাদেশি সংগঠন আছে। তা তিন শতাধিক হবে। এসব গ্রুপের মধ্যে, আদর্শগত ভীষণ পার্থক্য আছে। আমি স্বীকার করি এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করি। সচেতনতায় ঘাটতি আছে যে, রাজনীতিতে সবার প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন আছে। প্রবীণদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। আবার অনেকেই যথার্থ মনে করেন যে, রাজনীতিকরা তাদের নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকেন। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষমতাহীনতা অনুভব সৃষ্টি হয়। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের মধ্যে বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি হয়। চিরদিন যেমনটা রাজনীতির জন্য আমি তেমন অনুভূতি অনুসরণ করেছি। এটা শুরু হয়েছিল বাড়িতে। প্রতি রাতে আমার পিতা কাজ শেষে ঘরে ফিরে আসতেন। খবর দেখতেন। আমাদেরকে নিয়ে বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে এই আলোচনা করতেন। আমার মনে আছে, ১১ বছর বয়সে আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানচিত্র এঁকেছিলাম। তাতে রঙ করেছিলাম ওইসব রাজ্য, যেখাবে ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয়ী হয়েছিল।

প্রশ্ন: নিউ ইয়র্কে বসবাসরত পিতামাতারা কি যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া তাদের সন্তানরা বাঙালি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে বলে উদ্বিগ্ন?
উত্তর: হা। নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাসরত পিতামাতারা তাদের সন্তানদের এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ জন্যই তারা তাদের সন্তানদের পাঠান বাংলা স্কুলে অথবা তাদেরকে এমন সব কর্মকান্ডে যোগ দিতে পাঠান, যেখানে বাংলাদেশি বাংলাভাষী সন্তানরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারে। একই সঙ্গে, পিতামাতারা আন্তঃবিবাহকে বেশ গ্রহণ করছেন। বিশেষ করে এই শহরে। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে আমি বেশি মনে করি, পিতামাতারা চান তাদের সন্তানরা তাদের পিতামাতার ভাষা ও ইতিহাস যেন ভুলে না যায়।

প্রশ্ন: নিউ ইয়র্স সিটিতে তো বিপুল সংখ্যক ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি, শ্রীলঙ্কানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ বসবাস করেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই গ্রুপগুলোর মধ্যে কি আপনি ব্যাপক সহযোহিতা ও ঐক্য দেখতে পাচ্ছেন?
উত্তর: হা, আমি তাদের মধ্যে সহযোগিতা দেখতে পাই। আমি দেখি বিশ^মঞ্চে বিভিন্ন দেশের মানুষ হলেও, তাদের পার্থক্য থাকলেও, সেটা বড় বিষয় হয়ে ওঠে না, যখন আমরা সবাই নিউ ইয়র্কার। আমাদের সবার অভিজ্ঞতা এক। এখন এই করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন কিভাবে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে খাদ্য দান করছে এবং সময় দিচ্ছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877