মাত্র ১২ বছর বয়সে খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় শিউলি আক্তার কনার। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার। স্বামী মো. সোহেল মিয়া যাত্রাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী। ২০ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। ছেলেটি বর্তমানে স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।
কিন্তু বিয়ের ২০ বছর পরে চলতি মাসের ৪ জুন তার জীবনে নেমে আসে কাল বৈশাখী ঝড়। ওই দিন তার স্বামী সোহেল তাকে জানান, ‘তোমার আর তোমার ছেলের কোনো খরচ আমি দিতে পারবো না। কারণ তুমি আমাকে তালাক দিয়েছো।’ এ কথা বলেই প্রকাশ্যে রাস্তায় স্ত্রীকে মারধর করেন সোহেল।
তখনই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কনার। সে তখন চিৎকার করে বার বার বলছিলো, ‘আমি তো তোমাকে ডিভোর্স দেই নাই। কবে তোমাকে ডিভোর্স দিলাম! আমি তোমাকে ডিভোর্স দিলাম আর আমিই নিজেই জানি না!’
জবাবে সোহেল মিয়া বলেন, ‘তুমিই আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে, আমার কাছে প্রমাণ আছে। চাইলে তোমাকে দেখাতে পারি।’
পরে এই ডিভোর্সসংক্রান্ত একটি কাগজ দেখিয়েছেন কনার স্বামী সোহেল। যেখানে বলা আছে ১১ বছর আগে তার স্ত্রী শিউলী আক্তার কনা সেচ্ছায় তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। তবে স্থানীয় কাজী অফিসে খোঁজ নিয়ে প্রাথমিকভাবে ওই কাগজের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এভাবেই স্বামীর চরম জালিয়াতির শিকার হয়েছেন শিউলি আক্তার কনা নামে ওই নারী। ভুয়া ডিভোর্সনামা তৈরি করে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তার স্বামী সোহেল মিয়া।
ভুক্তভোগী শিউলি আক্তার কনা এই ঘটনার পরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলার কাগজপত্র, ভুক্তভোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিয়ের ২০ বছরে যা ঘটেছে
ভুক্তভোগী শিউলি আক্তার কনা দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমার স্বামী সোহেল সম্পর্কে আমার খালাতো ভাই। তাই পারিবারিকভাবেই ১৯৯৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে আমাদের একটি ছেলে হয়েছে। ওর বয়স বর্তমানে ১২ বছর। বিয়ের পরে আমাদের সংসার ভালোই চলছিলো। কিন্তু ২০০৮ সালে আমার স্বামী আমাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মূলত এর পর থেকেই আমার জীবনের যত সমস্যা শুরু হয়। ২০০৮ সালের পর থেকে ১১টি বছর ধরে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি আমি। মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করে সন্তানকে নিয়ে জীবন যুদ্ধ করে চলছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এত দিন আমার স্বামী আমার এবং ছেলের ভরণপোষণসহ স্কুলের পড়াশোনার কিছু খরচ দিত। আর আমি বাকিটা ম্যানেজ করে চলতাম। তিনি সম্পর্কে খালাতো ভাই হওয়ায় আমার আত্মীয় স্বজনরা এতদিন কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা না নিতে পরমর্শ দিয়েছিলো। তাই সব কিছু মুখ বুঝে এতদিন সহ্য করেছি।’
ছেলের জন্য টাকা চেয়ে হাতে পেলেন তালাকনামা
ভুক্তভোগী কনা গত চার জুনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৪ জুন মঙ্গলবার দুপুরে আমি সোহেলের কাছে নিজের ও সন্তানের পোশাক এবং ছেলের শিক্ষকের বেতন চাই। তখন সে তা দিতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।’
কেন দিতে পারবে না, কনা এ কথা জানতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে সোহেল বলে ওঠে, ‘“তোমার সঙ্গে তো আমার ডিভোর্স হয়েছে, তুমি কেমন করে আমার কাছে এসব চাচ্ছো?” তখন সোহেলকে প্রশ্ন করলাম কি করে ডিভোর্স হলো? কি বলছো তুমি উল্টাপাল্টা? কে কাকে ডিভোর্স দিলো?’
ওই নারীর ভাষ্য, ‘জবাবে স্বামী সোহেল বলেন, তুমিই আমাকে ডিভোর্স দিয়েছ, আমার কাছে প্রমাণ আছে। চাইলে তোমাকে দেখাতে পারি। ওই সময়ে সোহেল বলেন, তুমি দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে যাও আমি আসতেছি। সেখানেই তোমার সঙ্গে কথা বলবো।’
এরপরে তিনি স্ত্রী শিউলি আক্তার কনার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কাতর্কি করতে করতে দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আদর্শ বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে যায়। এরপর ভুয়া তালাকনামা শিউলির হাতে দিয়ে সোহেল বলেন, ‘এই দেখ, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো।’ এ সময় ওই ভুয়া তালাকনামা সোহেলের হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে নেয় কনা। তখন উত্তেজিত হয়ে স্বামী সোহেল মিয়া তাকে সেখানেই প্রকাশ্যে মারধর করেন।
স্ত্রীর মামলায় সেই স্বামী জেলে
গত ৪ জুনের ওই ঘটনার পরে ভুক্তভোগী শিউলি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন। এরপর সুস্থ হয়ে তিনি স্বামী সোহেলের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারায় মামলা (মামলা নং-১২) দায়ের করেন। ওই মামলায় সোহেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
ওই মামলার প্রথম শুনানির দিন সোহেলের পক্ষের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন। এ সময় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে সেই ডিভোর্সনামার একটি কপিও আদালতে দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু আসামিপক্ষ জামিন চাইলেও তা না মঞ্জুর করে আদালত।
মামলা করে প্রাণ ভয়ে সেই নারী
ভুক্তোভোগী ওই নারী অভিযোগ করেছেন যে, এই মামলার দ্বিতীয় শুনানির দিনে গত ১৬ জুন আদালত থেকে বের হওয়ার পরে, তার দেবরসহ আরো কয়েকজন তাকে ও তার সন্তানকে গুম করার হুমকি দিয়েছেন। আর এ বিষয়ে তিনি গত ১৭ জুন সোমবার কোতয়ালী থানায় একটি জিডি (নং-৬১৯) করেছেন। জিডির তদন্ত করছেন কোতয়ালী থানার এসআই মাইনুল হক খাঁন। যার এখনো তদন্ত চলছে।
কাজী অফিসে পাওয়া যায়নি ‘তালাকনামার কপি’
এই ঘটনার পরে ওই নারীর স্বামী সোহেল মিয়া যে কাগজটি দেখিয়েছেন। যাতে বলা আছে যে , শিউলি আক্তার কনা তার নিজ এলাকার কাজীর মাধ্যমে তার স্বামী সোহেল মিয়াকে তালাক দিয়েছেন। সেই কাগজের সূত্র ধরে দৈনিক আমাদের সময় অনইলাইনের পক্ষ থেকে দনিয়া এলাকার সহকারী কাজী হযরত আলীর কাছে তালাকনামা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।
তিনি দৈনিক আমাদের সময় অনইলাইনকে বলেন, ‘আমি একাধিকবার আমার সংগ্রহে থাকা বলিউম বই ঘেঁটে দেখেছি। যেখানে এই কাগজের তারিখ ও সাল অনুযায়ী কোনো রেকর্ড নেই। আমি ওই তারিখের বই বের করে রেখেছি।’
সোহেলের পরিবারের ভাষ্য
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত সোহেলের পরিবারের সাথে দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়।
গ্রেপ্তার সোহেলের ছোট ভাই মোঃ নাইম দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘ ভাই এসব বিসয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না। কারন আমি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম’।
সেই ডিভোর্সনামার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ আমরা শুনেছিলাম যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওই পক্ষ থেকেই ডিভোর্স দিয়েছে’।
কিন্তু ডিভোর্সনামার যে কাগজ দেখানো হয়েছে ওই এলাকার কাজীর কাছে গিয়ে তার কোন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনি সেই তারিখের ভলিয়ম বইয়েও এই নামের কোন দলিল নেই। এসব বিষয়ে প্রস্ন করা হলে সোহেলের ছোট ভাই মোঃ নাইম দৈনিক দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘ আমি এসব বিষয়ে জানি না ভাই। আমি বাইরে ছিলাম। পরিবারের কাছে জেনে পরে জানাতে পারাবো।’
এরপর তার মোবাইলে আরো কয়েক বার ফোন করা হলে তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
পুলিশের ভাষ্য
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ইমরুল হাসান দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘ওই নারীর দায়ের করা মামলায় তার স্বামীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’