তথ্য গোপন রেখে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইতে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে রিট করায় রিটকারী ড. কাজী এরতেজা হাসানকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ৩০ জুলাই আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তথ্য গোপন করার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য বলা হয়েছে।
আজ বুধবার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদেশের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল আমিন সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই এতে বেশকিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে ব্যাংকের গভর্নর গ্রন্থটি বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দেন এবং এটি রিভিউয়ের জন্য একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। ইতিহাস বিকৃতির প্রকাশনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া ওই পদক্ষেপের বিষয়টি গোপন করে ড. কাজী এরতেজা রিট করেন। আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীরা আদালতের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে হাইকোর্ট ওই বিষয়ে কাজী এরতেজা হাসানকে তলব করে তার ব্যাখ্যা জানাতে বলেছেন।’
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অন্তর্ভুক্ত না করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ইস্ট পাকিস্তনের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, গ্রন্থটি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশের পরপরই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যত্যয় পরিদৃষ্ট হলে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর গ্রন্থটির বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি গ্রন্থটি রিভিউয়ের জন্য একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি রিভিউ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এরপর গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তথ্য বিকৃতির ওই ঘটনা অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ভোরের পাতা ও দ্যা ডেইলি পিপলস টাইমস পত্রিকার সম্পাদক ড. কাজী এরতেজা হাসান। পরে ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ২ অক্টোবর রুলসহ অভিযোগ তদন্তের জন্য অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আদেশ দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশ অনুযায়ী অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট সাগ্রিক অর্থনীতি) ড. মো. জাফর উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত কমিটি হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধুর ছবি খুঁজে না পাওয়ায় তা ছাপানো হয়নি মর্মে বইটির প্রণয়ন ও প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি অন্তর্ভুক্ত না করায় ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে বলে কমিটি মনে করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের নামকরণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১২৭ নম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থে স্থান পায়নি তার (জাতির পিতা) ছবি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে জাতির পিতার ছবি ওই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক ছিল।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পাদনা কমিটি বলেছে গ্রন্থটিতে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি না ছাপনোই শ্রেয় ছিল। এ দু’জনের ছবি ছাপানোও ছিল সবার ভুল, বইটির সম্পাদক শুভঙ্কর সাহা স্বীকার করেন। তবে বইটিতে আইয়ুব খানের দমন পীড়নের কথা রয়েছে। কিন্তু গ্রন্থটিতে তার একাধিক ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা পরস্পরবিরোধী।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সম্পাদনা কমিটি বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতির পিতার ছবি খুঁজেছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত টিম বঙ্গবন্ধুর ছবি সংগ্রহ করতে পারেনি। এ কারণে ছবি ছাপানো যায়নি। কিন্তু গ্রন্থটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ ব্যাংক’ এর ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে বিধায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অথবা বঙ্গবন্ধুর অন্য যেকোনো ছবি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্ট গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে বইটির সম্পাদক শুভঙ্কর সাহাকে তলব করা হয়। ১২ মার্চ সশরীরে হাজির হয়ে বইটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি কেন স্থান পায়নি এবং বইটিতে কেন ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এরপর বইটির সম্পাদক হাজির হয়ে ওই বিকৃতির জন্য নি:শর্ত ক্ষমা চান। এ বিষয়ে বিস্তারিত শুনানিকালে আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তথ্য গোপন করে রিটটি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট রিটকারীকে তলব করেন।