বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

মহামারিতে মুমিনের করণীয়

মহামারিতে মুমিনের করণীয়

মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে তাঁর বান্দাদের ভয়, মুসিবত ও বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। এ ধরনের সময়ে মুমিনরা হা-হুতাশ করে না। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫)

এখন সে রকম একটি সময় বিশ্বের অনেক দেশ অতিবাহিত করছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে গোটা বিশ্ব থমকে গেছে, যার প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়ছে। যারা প্রবাসে আছেন, তাঁরা বাঙালি খাবারের সংকট অনুভব করছেন। আবার এই ভাইরাসে কিছু কিছু লোক নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

পবিত্র কোরআন থেকে উল্লিখিত আয়াতটির আলোকে আমরা বুঝতে পারি এখনই মোক্ষম সময় ধৈর্য ধারণ করার। পাশাপাশি আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করতে হবে। কারণ আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কেউ কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শন ও তাঁর সাক্ষাৎ অস্বীকার করে, তারাই আমার অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয় আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ২৩)

কিছুদিন পর পর নতুন নতুন রোগব্যাধি ও ভাইরাস এসে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা যত উন্নতিই করি, মহান আল্লাহর রহমত ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এ কারণেই আমাদের উচিত, আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা এবং সব পাপ থেকে মহান আল্লাহর কাছে তাওবা করা। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অর্জনের পরও যদি বিপদের সম্মুখীন হয়, সেটাও মহান আল্লাহ তার জন্য কল্যাণকর করে দেন। সুহায়ব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শোকর-গুজার করে আর অসচ্ছলতা বা দুঃখ-মসিবতে আক্রান্ত হলে ধৈর্য ধারণ করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর। (মুসলিম, হাদিস : ৭৩৯০)

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে আমাদের সর্বপ্রথম এটা চিহ্নিত করতে হবে যে এই রোগগুলো কেন হয়। এবং তা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। আধ্যাত্মিক দিক থেকে চিন্তা করলে পৃথিবীতে নতুন নতুন রোগব্যাধি, বিপদাপদ আসার কারণ মানুষের গুনাহ।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তা ছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)

করোনাভাইরাসও এমন একটি ভাইরাস যা এর আগে আর কখনোই পৃথিবীতে দেখা যায়নি। তবে ২০০২ সালে চীনে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামের একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে সংক্রমিত হয়েছিল আট হাজার ৯৮ জন। মারা গিয়েছিল ৭৭৪ জন। সেটিও ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো হলো কাশি, জ্বর, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, নিউমোনিয়া।

তাই এই মুহূর্তে আমাদের সবার উচিত, অশ্লীলতা ত্যাগ করা। ঘরে ঘরে কোরআন তিলাওয়াত করা। বেশি বেশি সদকা করা, সব সময় পবিত্র থাকা, পরিচ্ছন্ন থাকা। নামাজের মাধ্যমে বেশি বেশি বিপদ থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৪৫)

পাশাপাশি এ বিপদের মুহূর্তে আমরা বেশি বেশি সদকা করতে পারি। কারণ সদকার মাধ্যমে বিপদ দূর হয়ে যায়। মানুষের হায়াতে বরকত হয়, অপমৃত্যু কমে ও অহংকার অহমিকতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। (আত্তারগিব ওয়াত তারহিব : ২/৬৫)

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদুল আজহা অথবা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, হে মহিলা সমাজ! তোমার সদকা করতে থাক। কারণ আমি দেখেছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই অধিক। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও। (বুখারি, হাদিস : ৩০৪)

দেখুন উল্লিখিত হাদিসে রাসুল (সা.) মহিলাদের আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমরাও গোটা বিশ্বব্যাপী চলমান বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেশি বেশি সদকা করতে পারি।

এ ছাড়া মহামারির সময় আল্লাহর রাসুল, মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাতায়াত করতে নিষেধ করেছেন। তাই আমরা করোনা আক্রান্ত এলাকাগুলোতে যাতায়াত বন্ধ রাখতে পারি। বিনা প্রয়োজনে জনসমাগমে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সেখান থেকে চলে এসো না, অন্যদিকে কোনো এলাকায় মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত এলাকায় যাতায়াত থেকে বিরত থাকতে। পাশাপাশি জনসমাগম হয় এমন জায়গা এড়িয়ে চলতে। তাই আমাদেরও উচিত যতটুকু সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলা। সতর্ক থাকা।

এ ছাড়া এ সময় ডাক্তাররা সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। ইসলাম এ বিষয়টির প্রতি সব সময় জোর দিয়ে থাকে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, পবিত্রতা ইমানের অঙ্গ। (মুসলিম, হাদিস : ৪২২)

এ ছাড়া আরো বহু হাদিসে সার্বক্ষণিক অজু অবস্থায় থাকার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী বেশি বেশি সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি দিয়ে হাত ধোয়ার পাশাপাশি ঘন ঘন অজু করি, তাহলে একদিকে যেমন অজুর ফজিলত পাওয়া যাবে অন্যদিকে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার পদক্ষেপ গ্রহণ হবে।

এ ছাড়া অজুর মাধ্যমে প্রশান্তি অনুভূত হয়, ফলে হতাশা দূর হয়ে যায়। অজু আমাদের মুখের তৈলাক্ততা দূর করে। অজুর মাধ্যমে মুখে জমে থাকা ছত্রাকগুলো দূর হয়ে যায়। ফলে ঘুমানোর আগে অজু আমাদের ত্বকের জন্যও ভালো। বিউটি এক্সপার্টরা ঘুমানোর আগে ভালোভাবে মুখ ধোয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অজুর মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সালামত আজিজ বলেন, অজু হৃদরোগ আরোগ্য হওয়ার একটি উত্তম উপায়। পাশ্চাত্যের মনস্তত্ত্ববিদরা প্রতিদিন অজুর মতো করে কয়েকবার দেহে পানি লাগানোর পরামর্শ দেন। (পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানে মুহাম্মদ (সা.), পৃ. ১১২)

চিকিৎসাবিজ্ঞানে করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। কিন্তু রাসুল (সা.) একটি জিনিসকে মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের ওষুধ আখ্যা দিয়েছেন। তাই আমরা বেশি বেশি সেই জিনিসটি খেতে পারি।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, কালিজিরায় সকল প্রকার রোগের উপশম আছে, তবে ‘আস্সাম’ ব্যতীত। আর ‘আস্সাম’ হলো মৃত্যু। এর ‘আল হাব্বাতুস্ সাওদা’ হলো (স্থানীয় ভাষায়) ‘শূনীয’ (অর্থাৎ কালিজিরা)। (মুসলিম, হাদিস : ৫৬৫৯)

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে কাউকে পাপী ভাবা যাবে না।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচ পন্থায় মৃতগণ শহীদের মর্যাদাপ্রাপ্ত, ১. মহামারিতে মৃত, ২. পেটের পীড়ায় মৃত, ৩. পানিতে ডুবে মৃত, ৪. ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত, ৫. আল্লাহর রাস্তায় মৃত।’ (বুখারি, হাদিস : ২৮৩০)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সব ধরনের রোগব্যাধি ও বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুক। আমিন।

পাশাপাশি বেশি বেশি এই দোয়াটি পাঠ করা যেতে পারে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি, ওয়া মিন সায়্যিইল আসক্বাম’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি শ্বেত রোগ থেকে, পাগলামি থেকে, কুষ্ঠরোগ থেকে এবং দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৫৪ )

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877