অনুচয়নে: কাজী কাসেম
শুনে অনেকেই চমকে উঠবে- এশিয়া আমেরিকা সংযোগ স্থল পথ? হা, ঘটনাটা সে রকমই। রাশিয়া এলাকাধীন তিন দিকে সমুদ্র বেষ্টিত চুকচি উপদ্বীপ। এই উপদ্বীপটি এশিয়া মহাদেশের সর্ব পূর্ব কোনা। আমেরিকার আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের প্রিন্স অফ ওয়েলস নামক অন্তরীপটি রাশিয়ার চুকচি উপদ্বীপের কাছাকাছি একটি স্থান। বেরিং স্ট্রেইট একটু সরু সামদ্রিক জল এলাকা। এটি এশিয়া মহাদেশের সাইবেরিয়া অঞ্চলের সর্ব পূর্ব কোণা এবং উত্তর আমেরিকার সর্ব পশ্চিম কোণা। এই জলভাগ রাশিয়া ও আমেরিকা- এই দুদেশকে আলাদা করেছে। দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত এই জলরাশির বিস্তার মাত্র ৫৮ মাইল অর্থাৎ ৮৫ কিলোমিটার মাত্র। এখানে পানির গভীরতা মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ ফুট মাত্র। ডেনমার্কে জন্ম নেয়া রাশিয়ান নাবিক ভাইটাস বেরিং এর নামানুসারে এই প্রণালীর নাম হয়েছে। মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দী কালে রাশিয়ার নাবিকেরা ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ বলে এই এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
বেরিং স্ট্রেইট বা বেরিং প্রণালী এলাকাটা এক সময় নিচু স্থলভূমি ছিল। এটিকেই বলা হচ্ছে বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ বা বেরিং স্থলপথ। কথিত বেরিং স্থলভাগই আলাস্কা ও রাশিয়ার পূর্ব সাইবেরিয়া অঞ্চলের সীমা রেখায় অবস্থিত। সেই আদ্যি কালের বরফ যুগের সমুদ্রের উপরি তলা অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল। বেরিং ল্যান্ড ব্রিজের আর এক নাম বেরিঞ্জিয়া। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সুইডেনের উদ্ভিদবিদ্যা বিজ্ঞানী এরিক হাল্টেন এই এলাকার গাছগাছালি বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধ্যান করেন।বেরিঞ্জিয়া নামটা তারই দেয়া। উত্তর দক্ষিণে সব চেয়ে চওড়া যায়গায় এই প্রণালিটি প্রায় ১ হাজার মাইল বিস্তৃত।সেই আড়াই মিলিয়ন বছর আগের বরফ যুগের শেষ ভাগে অর্থাৎ এখন থেকে ১২ হাজার বছর আগে এই এলাকাটা শুকনা ছিল। এই বেরিং স্ট্রেইট নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। বোদ্ধা গবেষকেরা মোটামুটি একমত হয়েছেন যে এই শুখনো পথ মানুষ ও পশুপালের চলাচলের উপযোগী ছিল। খ্রিষ্ট জন্মের ১৩ থেকে ১০ হাজার বছর আগে এই শুকনো পথ ধরেই এশিয়া মহাদেশীয় অঞ্চল থেকে আমেরিকা মহাদেশে এসেছিল এক দল অভিবাসী।ধারণা করা হয় বর্তমান রাশিয়ার উত্তর পূর্ব কোনার এশীয় অঞ্চলের যাযাবর জনগুষ্ঠির লোক ছিল তারা। অনেকেই মনে করে থাকে যে পশু শিকারি এই যাযাবর গুষ্ঠি পশুপাল ধাওয়া করতে করতেই এই নতুন এলাকায় চলে আসে। এখানে পশু শিকার সহজ সাধ্য হওয়ায় ও বিভিন্ন খাদ্যোপযোগী ফলমূলের প্রাচুর্য দেখে তারা এখানেই স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে। সম্ভবত তাদের পূর্ব আবাসেও তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। নতুন আবাসে খাদ্যের প্রাচুর্য আছে এই রূপ সংবাদ পেয়ে ঐ অঞ্চলের আরও অনেক গোত্র এই নতুন দেশে চলে আসে। এই জন গুষ্ঠিই আজকের আমেরিকা মহাদেশে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা অন্তে নিশ্চিত হয়েছেন যে সেই আদিম বরফযুগে বেরিং ল্যান্ডব্রিজ নামে পরিচিত এলাকায় হিমবাহ জমতে পারেনি। কারণ হিসাবে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে সে সময় এই এলাকায় তুষারপাতের পরিমাণ কম ছিল। তাঁরা মনে করেন যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বায়ু প্রবাহ মধ্য আলাস্কার পর্বত মালার শিরদেশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়েই বায়ুতে সঞ্চিত জলীয় কণা নিঃশেষ হয়ে যেত। ফলে এই অঞ্চলে প্রবেশ করার আগেই ঐ বায়ু প্রবাহ জলকণা শূণ্য হয়ে পড়তো। ফলে এই এলাকায় তুষারপাত হতোনা বললেই চলে। তবে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে পৃথিবী ব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানীর উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলটি পানীতে তলিয়ে যায়।
এই অঞ্চলে প্রাপ্ত ফসিল দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে এক সময় খড়্গদন্ত বিশিষ্ট ব্যাঘ্র জাতীয় প্রাণী, লোমশ হস্তী ও অন্যান্য ছোট বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী এই বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ এলাকায় চড়ে বেড়াতো।রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলেও এক সময় এই সকল প্রাণীর অস্তিত্য ছিল। এই অঞ্চল দ্রুত পাণিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে এরা হয়তো জলমগ্ন হয়েই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
পশম যুক্ত হাতির ফসিল
খড়্গ দন্ত বাঘ মামা
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন সাইবেরিয়া অঞ্চলের যাযাবর মানুষের সাথে ঐ অঞ্চলের পরিব্রাজক পশুও এই বেরিং স্ট্রেইট অঞ্চলে এসে আস্তানা গেড়েছিল। অঞ্চলটি তলিয়ে যাওয়ার ফলে কিছু প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং অপেক্ষাকৃত কিছু চালাক প্রজাতির প্রাণী দ্রুত উত্তরে সরতে সরতে আলাস্কার ভিতর দিয়ে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে।