সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
মার্কিন পতাকা নামিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উড়লো ফিলিস্তিনি পতাকা! বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হচ্ছে: ওবায়দুল কাদের বিষয়টি আদালতেই সুরাহার চেষ্টা করব, হাইকোর্টের নির্দেশনা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী গাজার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে সৌদিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড চুয়াডাঙ্গায় দেশ থেকে আইনের শাসন উধাও হয়ে গেছে : মির্জা ফখরুল স্বর্ণের দাম ভরিতে কমলো ১১৫৫ টাকা তীব্র তাপপ্রবাহ : স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ হাইকোর্টের মঙ্গলবারও ঢাকাসহ ২৭ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে

বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বিশাল বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন এবং এর ভালো-মন্দ নিয়ে অনেকে নানা কথা বলছেন। আজকের বাজেট নিয়ে ঢালাওভাবে আমি মন্তব্য করব না। সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে আলোকপাত করব, যাতে বাজেটের পুরো বিষয়টা উঠে আসে। এখানে প্রধানত দুটি বিষয়ে আমি জোর দেব—বাজেটের সার্বিক মূল্যায়ন এবং বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো কী? চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে এবং কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

প্রথম কথা হচ্ছে, এবারের বাজেটটা কেমন হলো? নতুন অর্থবছরে নতুন মন্ত্রী এসেছেন। তিনি এবারই প্রথম বাজেট ঘোষণা করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, এবার নিশ্চয়ই নতুন এবং চমক দেওয়ার মতো কিছু থাকবে বাজেটে। সেটা কিন্তু আমরা দেখিনি। একই রকম বাজেট হয়েছে। আগের অর্থবছরে বা পুরনো বাজেটগুলো আমরা যেভাবে দেখেছি, এবারেও তার কোনো ব্যতিক্রম আমরা পাইনি। তেমন নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য দেখিনি। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি একটি ব্যতিক্রমী বাজেট দেবেন ভেবেছিলাম, আমরা সে রকম কিছু পাইনি। তিনি বলেছেন, এবারের বাজেটে সবাই খুশি হবেন। কেউ অখুশি হবেন না। কিন্তু বাস্তবে তো সেটা সম্ভব হবে না। বাজেটটা হচ্ছে ট্যাক্স পলিসির ওপর নির্ভর করে পরিচালিত একটা ব্যবস্থা, এটা দিয়ে তো সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়।

এবারের বাজেটকে বলা হচ্ছে বড় বাজেট। বড় বাজেট সন্দেহ নেই। কিন্তু খুব বড় বাজেটও বলা যায় না; কারণ এটি জিডিপির ১৭ বা ১৮ শতাংশ। এটা হতেই পারে। কথা হচ্ছে, বাজেট বাস্তবায়নে নিয়মিত ও নতুন যে বিষয়গুলো আছে এবং অন্যান্য পরিকল্পনা—সেগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করাটা কঠিন হবে।

প্রথম যে বিষয়টা সামনে আসে, বিরাট একটা রেভিনিউ (রাজস্ব) টার্গেট করা হয়েছে। রেভিনিউয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা কিন্তু অনেক বড়। বলা যায়, গতবারের চেয়েও এবারে বড় লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এনবিআর যে টার্গেট ধরেছে, সেটা আয় করা সহজ হবে না। গতবার তো তারা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এবারে এত বড় টার্গেট কিভাবে পূরণ করবে, সেটা একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। এনবিআর রেভিনিউ আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নামবে, সে জন্য কতগুলো পরিকল্পনা দরকার। বাস্তবে তো সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না। এনবিআরের লোকবল, দক্ষতা এবং কর আদায়ের প্রক্রিয়াগুলো উন্নত করা দরকার। আগের সেই পুরনো লোকবল ও অদক্ষতা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় সহজ হবে বলে মনে হয় না। ভ্যাট আদায়ের যে পদ্ধতি, সেটা যদি আধুনিকায়ন করা না যায়, তাহলে লাভ হবে না। ভ্যাট কে দিচ্ছে, কে দিচ্ছে না—এর একটা ডিজিটাইজড তথ্য থাকতে হবে। ইলেকট্রনিক রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি না থাকলে এ বিষয়ে সফল হওয়া জটিল হবে। এই ঘাটতি পূরণ না হলে অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দেবে এবং সেই সুযোগ এখানে আছে। এটা অসম্ভব কিছু নয়।

এডিবি বাস্তবায়নের জন্যও নতুন করে ভাবতে হবে। একটা হচ্ছে কোনোভাবে কাজ সমাধা করা, আরেকটি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো। এর জন্য তো দক্ষ কর্মশক্তি এবং সুপরিকল্পনা না থাকলে কাজ হবে না। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে পুরো ম্যানেজমেন্টকে একটা দক্ষ বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। টিম ও ম্যানেজমেন্ট যদি ভালো না হয়, পুরো বিষয়টা সমাধা করা জটিল হয়ে যায়।

বাজেট হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া, যেটা চলমান থাকে। যেমন—বাজেটটা দেওয়া হচ্ছে এক বছরের জন্য, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে, এমন নয়। আগের বছরে যে কাজগুলো শুরু হয়েছে বা বাকি আছে, ঘাটতি আছে, সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও বাজেটের বৈশিষ্ট্য। নতুন কাজ তো করতেই হবে, কিন্তু কাজগুলোর একটি সমন্বয় থাকতে হয়। নতুন অর্থবছরে নতুন নতুন কাজের সূচনা হবে, পরে সেগুলোর কোনো আপডেট রাখা হবে না—তা তো নয়।

বাজেটের আরেকটি দিক হচ্ছে উন্নয়নটা করতে হবে সমতাভিত্তিক। বাজেট ঘোষণা বা রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা দিলেই কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন হয়ে যাবে না। একদিকে যেমন রাজস্ব আয়ের জন্য ট্যাক্স আদায়ে জোর দিতে হবে, অন্যদিকে প্রণোদনা দিয়েও বাজেটের সার্বিক ব্যাপারটাকে ত্বরান্বিত করা যায়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সবার ওপরেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করের ভারটা এসেছে। এটাকে ভালোভাবে দেখভাল করতে হবে।

বাজেট ঘোষণার পর প্রায় সব ধরনের জিনিসই ভ্যাটের আওতায় এসেছে। এ ক্ষেত্রে কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, কিছু পণ্যের দাম কমে যাবে—এটা কিন্তু হয় না। এর কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই একটা পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তার পাশের অন্য পণ্যটির দাম আর কম থাকে না। ওটার দামও বেড়ে যায়। বাংলাদেশে এটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না। এখানে একটা জিনিস আরেকটি জিনিসকে প্রভাবিত করে। মনে করুন, কেউ গুঁড়া দুধের ব্যবসা করে, কেউ মোবাইলের ব্যবসা করে। তাদের বাজারমূল্য বেড়ে গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে যায় বা পাশে যারা থাকে বা একই ব্যক্তি হলেও সে-ও কিন্তু দামটা বাড়িয়ে দেয়। এর বাইরে আমরা যেতে পারছি না।

ক্রেডিট, রুলস, রেগুলেটর এবং ব্যাংকিং খাতের যে লেনদেন—সেসব কিভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেখা গেল না। কর্মসংস্থান নিয়ে বড় বা পরিকল্পিত কোনো কিছু বাজেটে দেখা গেল না। কর্মসংস্থানের সঙ্গে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগের একটি সম্পর্ক আছে। এখানে নানা ধরনের প্রণোদনা ও পরিকল্পনার দরকার। সেসব নিয়ে বড় কিছু নেই।

আমাদের যে পণ্যগুলো রপ্তানি করা যায়, তাদের প্রণোদনা দরকার। যেমন—চামড়া, সিরামিক, প্লাস্টিক ইত্যাদি। এদের জন্য সরাসরি প্রণোদনা দরকার। পাটের রপ্তানি কি সেভাবে হচ্ছে। এগুলো রপ্তানি করার জন্য যে ট্যাক্স ও পরিবহন সুবিধা—সেসব নিয়ে আরো ভাবতে হবে।

কর্মের সন্ধানে যারা বাইরে যায়, তাদের জন্য আরো বড় সুযোগ সৃষ্টির প্রতি জোর দেওয়া দরকার ছিল। যারা ছোট ছোট এন্টারপ্রাইজ চালায়, তাদের বড় পরিসরে আসার জন্য সুযোগ দরকার। এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু দেখলাম না।

কতগুলো জিনিস বাজেটে বেশ ভালোভাবে এসেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য যে সামান্য টাকা রাখা হয়েছে, যারা নানাভাবে ছোট ছোট কাজ করে, তাদের জন্য এটা একটা ভালো উদ্যোগ। যদিও এটা বড় কিছু নয়; কিন্তু সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এটা দিয়ে কী হবে। কারণ ১০০ কোটি টাকা তেমন কোনো বড় অঙ্ক নয় এবং এটা দিয়ে প্রায় কিছুই হবে না। এখন সরকার ইচ্ছা করলে ১০০ কোটি টাকার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কিছু একটা করতে পারে। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ২০৩০ সাল নাগাদ একটা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। দেখা যাক কী হয়। বাজেটে যে এ বিষয়ে একটা ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে, সেটাকে আমি সাধুবাদ জানাই।

সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ভালো দিক। মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় দিকগুলো ধীরে ধীরে উঠে আসতে শুরু করেছে, এটা একটা ভালো লক্ষণ ।

ব্যাংকিং খাতের কতগুলো সেবা আছে, সেগুলোর আওতা বাড়াতে হবে। লেনদেনের যে আইনগুলো আছে, সেগুলো আধুনিক করতে হবে। ব্যাংক খাতের যে অনিয়ম ও প্রভাব আছে, এগুলো দূর করতে হবে। ব্যাংকিং সুযোগগুলো মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত না রেখে এর সেবার আওতা বাড়াতে হবে। শেয়ার মার্কেটের সুযোগগুলো বাড়াতে হবে। বড় বা বিশাল প্রজেক্টগুলো ব্যাংক রিলেটেড হলে চলবে না। এতে ব্যাংকগুলো চাপে পড়বে। এটা নিয়েও ভাবতে হবে। ব্যাংকগুলোকে সংস্কার করতে হবে। এর ওপর নানামুখী যেসব চাপ রয়েছে সেগুলো কমাতে হবে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নতুন কিছু নেই। বরাবরের মতো বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শিক্ষার মানের জন্য এবং সাধারণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য জোর দেওয়া দরকার। কৃষি খাতের দিকে আরো একটু নজর দেওয়া দরকার ছিল। শস্যবীমার কথা বলা হয়েছে, সেটা এত সোজা নয়।

সার্বিকভাবে বাজেট সবার জন্য ভালো বা সুবিধার হোক, এটাই চাওয়া থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। তবে এখন যতটা সম্ভব বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্ব ও আন্তরিক চেষ্টা দরকার।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক, স্কুল অব বিজনেস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877