শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:৩৯ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
জমির বিরোধ নাকি প্রেম প্রত্যাখ্যান

জমির বিরোধ নাকি প্রেম প্রত্যাখ্যান

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার রেশ কাটেনি এখনো; এরই মধ্যে নরসিংদীর কলেজছাত্রী ফুলন রানী বর্মণকে (২২) প্রায় একই কায়দায় মারার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। শরীরের ২০ ভাগ আগুনে ঝলসে গেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে তার চিকিৎসা চলছে।

বড় ভাইয়ের শ্যালকের প্রেমপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান কিংবা চাচাদের সঙ্গে জমির বিরোধে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছে পরিবার ও প্রতিবেশীরা। গত বৃহস্পতিবার রাতে নরসিংদী পৌর এলাকার বীরপুরের এ ঘটনায় ফুলন রানীর বাবা যুগেন্দ্র বর্মণ বাদী হয়ে অচেনা দুজনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি কেরোসিনের বোতল, দিয়াশলাই বাক্স, ওড়না, ফুলনের পোড়া চুলসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রতিবেশীরা বলছেন, ফুলনের ভাই সুমনের শ্যালক সজিব রায় (২৭) দুবছর ধরে ওই কলেজছাত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন; কিন্তু সায় দিচ্ছিলেন না ওই তরুণী। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিহিংসা থেকেই হয়তো সজিব লোকজন নিয়ে ফুলনের গায়ে আগুন দিয়েছেন।

ঘটনার দিন রাত ২টার দিকে রায়পুরা উপজেলা থেকে সজিবকে আটকও করেছে পুলিশ। তার বাড়ি রায়পুরা থানাসংলগ্ন মিলন মন্দির এলাকায়। বাবার নাম লনী গোপাল রায়। যদিও ফুলন রানীর স্বজনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় হয়তো ফুলনের দুঃসম্পর্কের চাচা দিলীপ বর্মণ, শুকলাল বর্মণ, হীরালাল বর্মণ ও সুধীর বর্মণের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেননা তাদের সঙ্গে বসতবাড়ির ৪ শতাংশ জায়গা নিয়ে বিরোধ রয়েছে।

এ নিয়ে এলাকায় বেশ কয়েকবার দেনদরবারও হয়। জমির বিষয়ে ঘটনার পাঁচ দিন আগেও তারা ফুলনের বাবাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মারধর করেন। হুমকি দিয়ে এ-ও বলেছেনÑ এলাকা না ছাড়লে তারা এমন কিছু করবেন, যাতে সারাজীবনের জন্য যুগেন্দ্র বর্মণকে ভুগতে হবে। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সামনে গতকাল দুপুরে মেঝেতে বসে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন ফুলনের মা অঞ্জলী চন্দ্র রানী।

কিছুক্ষণ পর পর আইসিইউর ভেতরে থাকা বড় মেয়ে দোলন বর্মণের কাছে ফুলনের অবস্থা জানতে চাইছেন উদগ্রীব হয়ে। দোলন সার্বক্ষণিক ছোট বোনের পাশে পাশে রয়েছেন। আইসিইউর বাইরে বিচলিত মাকে কখনো বুকে জড়িয়ে কখনোবা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¦না দিচ্ছিলেন ছেলে সুমন বর্মণ। বোনের এই করুণ পরিণতিতে তিনিও শোকাতুর।

ভাঙা কণ্ঠে অঞ্জলী রানী আমাদের সময়কে জানান, দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ফুলন রানী সবার ছোট। নরসিংদীর উদয়ন কলেজ থেকে গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও আর্থিক দুরবস্থার কারণে কোথাও ভর্তি করা হয়নি তাকে। ফুলনের বাবা যুগেন্দ্র বর্মণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক ডা. সাইফুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর শাজাহান মোক্তার নামে ফুলনের বাবার এক পরিচিতজন কাজের সূত্রে তাদের বাড়িতে আসেন। এ সময় বাসায় একাই ছিলেন ফুলন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে শাজাহান ফিরে যাওয়ার সময় ফুলন তার সঙ্গে কেক কিনতে যান। কেক কিনে ও মোবাইল ফোনে রিচার্জ করে রেললাইন পার হয়ে একাই বাড়ি ফিরছিলেন তার মেয়ে।

বাড়ির প্রায় একশ গজ দূরে নির্জন গলির মুখে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবককে সিগারেট খেতে দেখেন তিনি। তাই ভয় পেয়ে দ্রুত পা চালান ফুলন। কিন্তু দুই যুবক দৌড়ে এসে পেছন থেকে কাপড়ের মতো কিছু একটা দিয়ে ফুলনের মুখ চেপে ধরে। একপর্যায়ে তারা খোলা একটি জায়গায় শোয়ায়। দুর্বৃত্তদের একজন তার মুখ-হাত চেপে ধরে রাখে এবং অন্যজন জোর করে হাঁ করিয়ে মুখে কেরোসিন ঢালার চেষ্টা করে।

এতে ব্যর্থ হয়ে মাথা-শরীরে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফুলন এ সময় চিৎকার দিয়ে দিগ্বিদিক ঘুরতে থাকেন। একপর্যায়ে গড়াগড়ি দিতে থাকেন বালুতে। পরে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তবে অন্ধকারে তাদের চিনতে পারেননি ফুলন। স্থানীয়রা পানি ও ভেজা চটের বস্তা চাপা দিয়ে শরীরের আগুন নেভানোর আগেই তার মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত পুড়ে যায়।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতেই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে বার্ন ইউনিটের ব্লু ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ফুলন। অবস্থার আরও অবনতি হলে শুক্রবার সকালে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. নাসিম আল ইসলাম জানান, ফুলন রানীর মাথা, দুই বাহু ও পেছনের অংশসহ শরীরের ২০ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে।

দাহ্য পদার্থ দিয়ে যে তাকে পোড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এটা স্পষ্ট। তবে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা ফুলনের শরীরের ১২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে জানালেও আশঙ্কামুক্ত বলছেন না। ফুলনের ভাই স্বর্ণের কারিগর সুমন বলেন, ‘৬০ বছর ধরে ভোগদখলে থাকা আমাদের বসতভিটার চার শতাংশ জায়গা জবরদখলের জন্য এক বছর ধরে চেষ্টা করছেন পাশ্ববর্তী বাড়ির কয়েকজন। তারা আমার দুঃসম্পর্কের চাচা। এ নিয়ে এলাকায় বেশ কয়েকবার দেনদরবারও হয়েছে। ফুলনের গায়ে আগুন দেওয়ার পাঁচ দিন আগেও তারা বাবাকে এলাকা না ছাড়লে প্রাণনাশসহ বড় ধরনের ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছিলেন।

বাগ্বিত-ার একপর্যায়ে বাবার গায়ে হাতও তোলেন তারা।’ শ্যালকের প্রেম প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সজিব আমার বোন ফুলনকে পছন্দ করত বা তাকে এ বিষয়ে কিছু বলেছে বলে শুনিনি কখনো। মূলত ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতেই একটি মহল প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে।

যারা আমাদের জমি দখলে নিতে চায়, তারাই ফুলনের গায়ে আগুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে বদ্ধমূল ধারণা আমাদের।’ বোনকে যারা পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান সুমন। নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) মিরাজ উদ্দিন আহমেদ জানান, কলেজছাত্রী ফুলনের গায়ে আগুন দেওয়ার খবর পেয়ে রাতেই অভিযানে নামে পুলিশ।

তবে কারা কী কারণে ঘটনাটি ঘটাতে পারে, তেমন কিছুই ধারণা দিতে পারছে না পরিবার। ঘটনাস্থল থেকে দাহ্য পদার্থের বোতল, ম্যাচ, মেয়েটির পুড়ে যাওয়া চুলসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। কিনে আনা ওই কেকও ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল। এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে মামলা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সজিব নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে।

পুলিশ সুপার বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দা ও বাদী যে বিষয়গুলো আমাদের বলেছেন, সেগুলো মাথায় নিয়ে আমারা কাজ করছি। এখানে প্রেম, জমিÑ সবগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরাও ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছেন। জড়িতদের চিহ্নিত করা ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877