শায়খ ড. আবদুল বারি বিন আওয়াদ আস-সুবাইতি: ঈমানের খোঁজখবর রাখা ও পরিচর্যা করা একজন আদর্শ মুসলিমের বৈশিষ্ট্য এবং প্রকৃত বুদ্ধিমানদের অভ্যাস। রাসুল (সা.) বলেন ‘কাপড় যেভাবে পুরোনো হয়ে যায় ঠিক তোমাদের ভেতরে ঈমানও পুরোনো হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা কর যেন তিনি তোমাদের হৃদয়ে ঈমানকে নবায়ন করে দেন।’ রাসুল (সা.) আরও বলেন ‘কলবের নাম কলব রাখা হয়েছে এর অবস্থার পরিবর্তনের কারণে। অন্তরের উপমা হচ্ছে গাছে ঝুলন্ত পাখির পালকের মতো। বাতাস তাকে উল্টেপাল্টে দেয়।’ মোমিন তার ঈমানের নবায়ন করে; কারণ ঈমান এক অবস্থায় স্থির থাকে না। বরং ইবাদতে মন্দাভাব ও দুর্বলতায়, আল্লাহ থেকে বেখবরি ও গাফিলতিতে এবং প্রবৃত্তির মাঝে ডুবে থাকার ফলে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়।
মানুষের শক্তি সীমিত, স্বভাবগতভাবে দুর্বল। তার বসবাস দুর্বলতা আর অক্ষমতার মধ্যেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘মানুষকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা নিসা : ২৮)। ফলে মাঝে মধ্যে মুসলিমের মাঝে যে অলসতা-ঔদাসীন্য দেখা দেয়, অথবা তার পা পিছলে যায়, সেটা পালনকর্তার হেকমত ও প্রজ্ঞা থেকে খালি নয়। সে হেকমতের একটি হচ্ছে তার পালনকর্তার দিকে ফিরে আসা এবং হৃদয়ে জাগরণ সৃষ্টি হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বেশি বেশি তওবাকারীদের পছন্দ করেন। তাদের তওবায় তিনি খুশি হন। রাসুল (সা.) বলেন ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা যদি গোনাহ না করতে, তাহলে তিনি তোমাদের নিঃশেষ করে এমন জাতিকে নিয়ে আসতেন, যারা গোনাহ করত অতঃপর আল্লাহর কাছে মাফ চাইত। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের মাফ করে দিতেন।’
ঈমান বাড়ে এবং কমে। আনুগত্যের মাধ্যমে বাড়ে আর গোনাহের মাধ্যমে কমে যায়। হৃদয় যখন অসতর্কতা থেকে জেগে ওঠে, আনুগত্য ও ঈমানের আমল করতে শুরু করে, তখন ঈমান বৃদ্ধি পায়। বিশ্বাস শক্তিশালী হয়। আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামত দেখতে শুরু করে। তখন আল্লাহর জন্য তার ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। তার জিকিরে প্রশান্তি পায়। কল্যাণের কাজ এবং তওবা করতে দ্রুত এগিয়ে আসে। যেন তার ত্রুটিবিচ্যুতি এবং গাফিলতির কারণে যা হারিয়েছে, তা পেতে পারে।
সেজন্যই ঈমানের খোঁজখবর রাখার আগ্রহ এবং ঈমানকে উন্নত করার আমল আল্লাহ তায়ালার সৎ বান্দাদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য। আবু দারদা (রা.) বলেন ‘বান্দা প্রজ্ঞাবান হওয়ার নিদর্শন হচ্ছে, সে ঈমানের খোঁজখবর রাখবে এবং ত্রুটি হয়েছে কি না, তা খেয়াল করবে। তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হচ্ছে, সে ঈমান বাড়ছে না কমছে, তা জানবে।’ ওমর (রা.) তার সঙ্গীদের বলতেনÑ ‘আসো আমরা ঈমান বৃদ্ধি করি।’ ফলে তখন তারা আল্লাহর জিকির শুরু করতেন। ইবনে মাসউদ (রা.) তার দোয়ায় বলতেন ‘হে আল্লাহ, আমাদের ঈমান, বিশ্বাস এবং ফিকহ বৃদ্ধি করে দিন।’ মুয়াজ (রা.) যে কাউকে বলতেন, ‘চলো আমরা একসঙ্গে বসি, কিছুক্ষণ ঈমান নিয়ে কথা বলি।’
মোমিন যত উচ্চ ঈমানের অধিকারীই হোক, সে নিজের ব্যাপারে নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে অবিচলতার জন্য আল্লাহর দিকে ফিরে আসাই সঠিক পথ। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে ‘হে আমাদের পালনকর্তা, সরলপথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮)। রাসুল (সা.) খুব বেশি বলতেন ‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন।’
মোমিন যেহেতু জানে, শয়তান তার দিকে নজর রাখে; তাই সে শয়তানের ছোবল প্রতিহত করে, তার কুমন্ত্রণা প্রতিরোধ করে। তার পথগুলো বন্ধ করে দেয়। সর্বোপরি সে তার পালনকর্তার সাহায্যে পরাজিত ও পরাস্ত হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘অতএব যখন আপনি কোরআন পাঠ করেন, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন। তার আধিপত্য চলে না তাদের ওপর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আপন পালনকর্তার ওপর ভরসা রাখে।’ (সূরা নাহল : ৯৮-৯৯)।
যে পাথেয় খোঁজে তার জন্য সবচেয়ে উত্তম পাথেয় এবং অবিচলতার পথে সবচেয়ে উত্তম সঙ্গী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব আঁকড়ে ধরা। এর ওপর আমল করা। যে এ কিতাব আঁকড়ে ধরবে আল্লাহ তাকে বাঁচাবেন। যে ব্যক্তি এর অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেবেন। সচেতন মুসলিম গাফিলতির মুহূর্ত এবং অবহেলার বিপদ থেকে দ্রুত বেরুতে চায়। কেননা সে আনুগত্যে আনন্দিত হয় এবং তার পালনকর্তার সন্তুষ্টি তালাশ করে।
এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছে ঈমান কী? তিনি বললেন ‘যখন তোমার ভালো কাজ তোমাকে আনন্দ দেবে এবং তোমার খারাপ কাজ তোমাকে কষ্ট দেবে, তখন (বুঝবে) তুমি মোমিন।’ যার হৃদয়ে কোরআনের নুর আছে, ঈমানের স্বাদ উপভোগ করে এবং যে জানে যে তার একজন দয়াবান পালনকর্তা রয়েছে, যিনি বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন সে কীভাবে আল্লাহ থেকে উদাস এবং ইবাদত থেকে অমনোযোগী থাকতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘যে গোনাহ করে বা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রর্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সূরা নিসা : ১১০)।
আল্লাহর জিকির এবং তাঁর নিদর্শন নিয়ে চিন্তাভাবনা অন্তর জাগ্রত করে। ঈমান বৃদ্ধি করে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যারা ঈমানদার তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় তাঁর কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরোয়ারদেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে।’ (সূরা আনফাল : ২)।
মোমিনের উচিত যখন তার হৃদয় গাফেল হয়, তখন সাবধান হওয়া। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া; যখন তা অবসাদগ্রস্ত হয়ে যায়। তাকে আল্লাহর ক্রোধ ও গজব থেকে সতর্ক থাকতে হবে। রাসুল (সা.) দোয়া করতেনÑ ‘হে আল্লাহ আমি আপনার নেয়ামত চলে যাওয়া, সুস্থতার বিবর্তন, তোমার হঠাৎ শাস্তি এবং সবধরনের ক্রোধ থেকে পরিত্রাণ চাই।’
হৃদয় কখনও দুনিয়ামুখী হয়, কখনও বস্তুর পেছনে দৌড়াতে থাকে। সেজন্যই আল্লাহ তায়ালা অধিক পরিমাণে জিকিরের নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বীনের অপরিহার্যতা আর দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যেন ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘মোমিনরা তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল-বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।’ (সূরা আহজাব : ৪১-৪২)। তেমনি বৈধ কাজে বাড়াবাড়ি এবং প্রচলিত কাজে অপচয় অবসাদ সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘হে বনি আদম, তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও-খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)।
বুদ্ধিমানদের কাছে অস্পষ্ট নয় যে, দুর্বলচিত্ত ও অসদিচ্ছার মানুষের সঙ্গ গাফলত ও অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়। মুসলিম যদি গাফিলতির ব্যাপারে বেপরোয়া হয় এবং অবসাদ দূর করতে শৈথিল্য করে, তাহলে তার ওপর হৃদয় কঠিন হওয়ার বিভিন্ন উপকরণ চেপে বসে। ইবাদত সম্পাদন তার কাছে বোঝা হয়ে ওঠে। পুণ্য অর্জন তার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। হৃদয় পচে যায়। ঈমানের অগ্নিশিখা নিভে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর তাদের জন্য দুর্ভোগ, তারা সুস্পষ্ট গোমারাহিতে রয়েছে।’ (সূরা জুমার : ২২)। মোমিন যদি তার অন্তরের খোঁজখবর না রাখে সে এমন অবস্থায় উপনীত হয়, যার কথা আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মতো অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। পাথরের মধ্যে এমনও আছে, যা থেকে ঝরনা প্রবাহিত হয়, এমন আছে, যা বিদীর্ণ হয়, অতঃপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং এমনও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে খসে পড়তে থাকে। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বেখবর নন।’ (সূরা বাকারা : ৭৪)।
মোমিন যতই গাফেল হোক আর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ুক এবং পা ছিটকে পড়ুক তার জন্য রয়েছে তওবার দরজা খোলা। কল্যাণের দিকে ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত। আর আল্লাহ তায়ালা বারবার ফিরে আসা ব্যক্তিকে, তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং তিনি হাদিসে কুদসিতে বলেন ‘হে আমার বান্দা, তোমরা রাতে-দিনে ভুল কর। আর আমি সব গোনাহ ক্ষমা করে দিই। তাই তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেব।’
১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১ হিজরি মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ মুহিউদ্দীন ফারুকী