স্বদেশ ডেস্ক:
বছরজুড়ে বিরোধী রাজনীতিতে আলোচনায় ছিল ‘বিতর্কিত’ একাদশ সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনোত্তর কিংবা বছরজুড়ে এই ইস্যুতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিরোধীরা। খৈ ফুটেছে কেবল মুখেই। কখনো ভোট ডাকাতির নির্বাচন কিংবা মধ্যরাতের নির্বাচন বলে তারা রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করেছে। কর্মসূচি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অন্য দিকে ওই নির্বাচনে ৭৬.৮৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারও ছিল নির্বিকার। নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের উচ্চবাচ্য গত এক বছরে তারা বলতে গেলে পাত্তাই দেয়নি। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দিনকে দিন আরো পাকাপোক্ত হচ্ছে। ক্ষমতার ভিত আরো বেশি মজবুত ও প্রলম্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোচ্ছে তারা। পাশাপাশি উন্নয়নের সেøাগানকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৮২ শতাংশ আসন লাভ করে। অন্য দিকে বিএনপি ৩.৩ শতাংশ আসন পায়। নির্বাচনের এই ফলাফল বিরোধী জোট বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের জন্য ছিল চরম অনাকাক্সিক্ষত ও অভাবনীয়। যদিও বিরোধীদের জন্য খারাপ ফলাফল হতে যাচ্ছে, এমন লক্ষণ নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি বলে দিচ্ছিল।
নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৯ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়; যার মধ্যে আটজন নিহত হন ও ৫৬০ জন আহত হন। বিএনপি অফিসের দেয়া তথ্যানুসারে, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর (যাদের অধিকাংশ বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী) ওপর দুই হাজার ৮৩৩ হামলা হয়েছে। এতে ১২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছেন। নির্বাচনের আগের মাস ৮ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় এক হাজার ৫৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সময়ে ১৫ হাজার ৫৬৮ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। একটি ইংরেজি পত্রিকার তথ্য অনুসারে ১০ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৫৬ জন প্রার্থী (যাদের অধিকাংশ বিএনপির) হামলার শিকার হয়েছেন, এক হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছন ও ৮০০ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় ১৫ জন নিহত হন। বিরোধীদের জন্য এরকম একটি প্রতিকূল অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচন।
নির্বাচনের দিনই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানান। ওই দিন তিনি বলেন, সারা দেশের প্রায় সব জায়গায় ভোট ডাকাতি হয়েছে। অবিলম্বে এই প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করতে হবে। সেই সাথে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচন দিতে হবে।
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুলভাবে হেরে যাওয়ার পর দলের বেশ কিছু প্রার্থী বিশেষ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মোট ৭৪টি মামলা দায়ের করে। যদিও আজ পর্যন্ত এসব মামলার শুনানি হয়নি।
নির্বাচনের কয়েক মাসের মাথায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলে টিআইবি। তারা ৫০টি আসন নিয়ে গবেষণা করে ৩৩টিতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল দেয়ার অভিযোগ পেয়েছে বলে দাবি করে। টিআইবি ২৯৯ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি আসনে গবেষণার যে তথ্য দিয়েছে, তাতে গড়ে ৯৪ শতাংশ আসনে নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। জাল ভোট পড়েছে ৮২ শতাংশ আসনে। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্সে সিল মারা হয়েছে ৬৬ শতাংশ আসনে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছি। আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে নির্বাচনের এই ধারা কোনোভাবেই অব্যাহত থাকতে পারে না। এটি অব্যাহত থাকলে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র সুদূরপরাহত হয়ে উঠবে। এ কারণেই আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। আশা করছি সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হবে।
নির্বাচনোত্তর গত এক বছর সাদামাটাই কেটেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের কারামুক্তির দাবি নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিএনপি। শত চেষ্টা করেও দলটি আইনি লড়াইয়ে দলের নেত্রীকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি।
নির্বাচনে অভাবনীয় ফলাফলের পর নির্বাচিত আট এমপির শপথ না নেয়া এবং পরবর্তীতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে তারা অটল থাকতে পারেনি। একপর্যায়ে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেয়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে সব নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে ২৯ ডিসেম্বর মধ্য রাতেই নির্বাচন হয়েছে বছরজুড়েই এমন বক্তব্য দিয়ে এসেছেন দলটির নেতারা। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী গত এক বছরে সঙ্ঘবদ্ধ কোনো কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন গতকাল ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। গতকাল নয়াপল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে তারা। এ ছাড়া কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ প্রতিবাদে সমাবেশ, কালো ব্যাজ ধারণ ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় অফিসগুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন।
বিরোধীদের উচ্চবাচ্য আমলে না নিয়ে সরকার নিজেদের মতো করে সামনে এগোচ্ছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসীন তারা। আওয়ামী লীগের এই শাসন আরো বেশি প্রলম্বিত হতে পারে এমন ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
দলটি বছরের শেষে এসে কাউন্সিল করেছে। নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে দলটি। অন্য দিকে বিএনপি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। মামলা-হামলা থেকে তাদের কোনো নিস্তার মিলছে না। দল গোছাবে না নেত্রীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করবে কোনোটিই কার্যকরভাবে করতে পারছে না তারা। যদিও নেতাকর্মীদের নতুন স্বপ্নে তারা আশ্বস্ত করতে চায়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ভাষায়Ñ সুসময় আসবে। স্বৈরাচারী সরকারের শিগগিরই পতন হবে।