শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৮ পূর্বাহ্ন

নাগরিক আইনের পরিণতি কোন দিকে?

নাগরিক আইনের পরিণতি কোন দিকে?

আহমদ রফিক:

ভারতে নাগরিকত্ব আইন কি বুমেরাং হতে যাচ্ছে বিজেপির একটি উচ্চাশায় ছাই ঢেলে দিয়ে? এ নিয়ে অশান্ত উত্তাল ভারতে বিজেপি কি পিছু হটবে? না, এত সহজে হটার পাত্র নন মোদি, অমিত শাহ প্রমুখ হিন্দুত্ববাদী। তাঁরা সাফল্য নিয়েই এগোচ্ছেন গণতন্ত্রী একদা সেক্যুলার ভারত রাষ্ট্রকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে। আপাতত তাঁদের পায়ের তলার মাটি বেশ শক্ত, মজবুত। একদা নির্বাচনে প্রাপ্ত দুই আসন এখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরিণত।

এর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দীর্ঘ। সে ব্যাখ্যার মূল দায় পূর্ববর্তী লাগাতার শাসক কংগ্রেসের সব নেতার না হলেও অনেকের। আদর্শিক দিক থেকে বিভ্রান্তিকর রাজনীতির টানে বিজেপিকে অনেক রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে কংগ্রেস—প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। শেষোক্ত পথেই বেশি।

তাই পিছু হটেনি বিজেপি বিতর্কিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসের উন্মাদনা থেকে। বিরোধীপক্ষ তারা। তবু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার সে অনৈতিক ও বেআইনি কাজে বাধা দেয়নি। রথযাত্রা নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিও পদদলিত করে এগিয়ে গেছে। সিপিএমের জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ। হাতের কাছে তাদের পুস্তিকাটি নেই, তাই উদ্ধৃতি দেওয়া গেল না।

স্থিতাবস্থার নির্দেশদানকারী হাইকোর্টও নীরব, স্তব্ধ প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতিমনস্ক নরসিমা রাও, তাঁর যুক্তিটাও ফাঁপা অর্থহীন। এমন এক অনুকূল পরিবেশে বাবরি মসজিদের ছাদে আদভানি-উমা ভারতী প্রমুখের উদ্বাহু নৃত্য বৈনাশিক হাতুড়ির ঘায়ের তালে তালে। মসজিদ ধ্বংস। দাবি মাটির গভীরে রামমন্দির ছিল। এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খনন বলছে, নিচে ধ্বংসাবশেষ কিছু আছে, তবে তা মন্দিরের নয়। তবু সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত রায়। একটু তুলনা টানা যাক।

বুশ-ব্লেয়ারের অভিযোগ, সাদ্দামের হাতে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, বিশ্ব বিপন্ন। মারো তাকে। কাটাকুটি শেষ। কিছুই পাওয়া গেল না। ইরাকও শেষ। এখন নির্লজ্জ টনির স্বীকারোক্তি ‘ওটা ভুল ছিল’। সে ভুলের খেসারত দিচ্ছে ইরাকবাসী শিয়া-সুন্নি পারস্পরিক সংঘাতে।

এদিকে খুশি বিজেপি—কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা-রায় তাদের পক্ষে। ওখানেই রামমন্দির নির্মিত হবে, বাবরি মসজিদ অন্যত্র সরকারি দানের জমিতে—সান্ত্বনা প্রলেপ। একের পর এক জয়, বিজেপি থামবে কেন? সুবিচারের সর্বোচ্চ ও একমাত্র আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালতও তাদের পক্ষে—হিন্দুত্ববাদ জাদুমন্ত্র।

দুই.

নেহরুর ভারত, আম্বেদকরের ভারত—এক কথায় বিশ্ব-গণতন্ত্রী সেক্যুলার ভারত এখন বিজেপির শাসনে হিন্দুত্ববাদী ভারত গঠনে দৃঢ়পদে অগ্রসর। তারা পিছু হটবে কার ভয়ে। দুই আইনি সভা তাদের নিয়ন্ত্রণে। ভোটের জনতা ভোটের ভারত পূর্বোক্ত নানা কারণে এখন হিন্দুত্ববাদী দলের সমর্থক। আদর্শের চেয়ে উন্নয়নের মোয়া অনেক সুস্বাদু ও মিঠা। আদর্শ ধুয়ে জল খায় তো বোকারা। একুশ শতকের তরুণ অনেক স্মার্ট, বয়স্করা হিসাবি। কাজেই বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়। বেরিয়ে আসুক না কেন থলে থেকে দুর্নীতির কিছু কমলা, আপেল।

অসীম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিজেপি একের পর এক তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। রামমন্দির হাতের মুঠোয় নিয়ে রামরাজ্য (আসলে মোদি-অমিত সাম্রাজ্য) প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আগুয়ান বিজেপি। কাশ্মীরকে দুফালা করা হয়েছে সংবিধান অমান্য করে। সর্বোচ্চ আইন বিভাগীয় এথিকস নিশ্চুপ। ভারতকে বিধর্মীমুক্ত করতে হবে আধুনিক হিন্দু ভারতের বৈদিক প্রাচীন ভারতের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে।

পাশে মুসলমানপ্রধান প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত রাখতে হবে। তাই সদ্য পাস করা নাগরিক আইন নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা : ‘ভারত থেকে মুসলমানদের তাড়াতে এই আইন নয়, তাদের আটক করে রাখার জন্য আলাদা কোনো আটক কেন্দ্রও খোলা হয়নি। সবই অপপ্রচার।’ আসামে নাগরিকপঞ্জি করার সময় শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করতে একই ধরনের কথা বলেছিলেন মোদি।

মোদি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ রাজনীতিক; যদিও সুকৌশলী হিন্দুত্ববাদী। এক হাতের মুঠোয় একাধিক রাজনৈতিক চালের ঘুঁটি ধরে রাখতে পারেন তিনি। তাই আসাম নাগরিকপঞ্জিমাফিক বাঙালি-বাংলাদেশি তাড়ানোর কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন। শেখ হাসিনা আপাত স্বস্তিতে। কিন্তু বিজেপির ঘোষণামাফিক রাজ্যে রাজ্যে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শনাক্ত করার উইচ হান্টিংয়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে এই নাগরিকত্ব আইন পাস এবং তা নিয়ে অভয়বাণী, বরাভয় মুদ্রা। তা দেখে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ নীরব থাকলেও খোদ মোদির স্বদেশ নীরব শান্তি নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশ নিজেকে আপাতদৃষ্টিতে শাসনতান্ত্রিক দিকে শান্ত দেখালেও ক্ষোভে প্রতীকী ধারায় প্রকাশ পেয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হঠাৎ ভারত সফর বাতিলে।

তিন.

বাংলাদেশের নমনীয়তার শান্তি বিজেপির জন্য বা মোদির জন্য শেষ শান্তি হয়ে দাঁড়ায়নি। অনেকটা অভাবিত ধারায় খোদ আসাম থেকেই নাগরিক আইনের জনপ্রতিবাদ শুরু মিছিলে-স্লোগানে—নাগরিক আইন সংশোধন করতে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতার ক্ষুব্ধ ঘোষণা—এ আইন মানি না, শুকনা বারুদে স্ফুলিঙ্গপাত। ব্যাপক প্রতিবাদ, তাও আবার সহিংস—যে জন্য মমতাকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে হয়—‘সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা চলবে না।’ মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েও পরোক্ষে আন্দোলনের নেত্রী।

তাই বিজেপি নেতৃত্ব মমতার কাঁধে অরাজকতার সব দোষ চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছিল। কিন্তু জনমানস, ছাত্র-ছাত্রীমানস পরিমাপ করতে তাদের যন্ত্র সঠিক ছিল না। দ্রুতই এ আন্দোলন দিল্লিসহ কমবেশি সব রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সাংবাদপত্রের শিরোনাম : ‘অগ্নিগর্ভ ভারত’। সেই সঙ্গে বলতে হয় : অশান্ত ভারত।

উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশির ভাগ রাজ্য মিছিলে-স্লোগানে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে অনেক দিন পর নতুন মূর্তি ধারণ করেছে। এক কথায় নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ভারত উত্তাল। এর মধ্যে কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনাও রয়েছে। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে প্রতিবাদ দিল্লিতে। তাও আবার জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ক্যাম্পাসে, রাজপথে।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে বাঙালি সমাজে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী ভূমিকা অসাধারণ। জামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পুলিশি হঠকারিতায় মারাঠি মুখ্যমন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য : ঘটনা আমাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দিল্লি হয়ে বিহার, উত্তর ভারত—আন্দোলনের বিস্তার, সহিংসতার প্রমাণ মৃত্যু।

একটি সংবাদ শিরোনাম : ‘উত্তর প্রদেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ৬’ (২১-১২-২০১৯)। এবার নীতিশ কুমার বললেন : ‘বিহারে এনআরসি নয়’। অথচ নীতিশ কুমার বিজেপি জোটভুক্ত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতে বিরোধীরা এ আইনকে মুসলিমবিদ্বেষী আইন হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবাদে বিক্ষোভে রাজপথে নেমেছে। ভারতে ছাত্র আন্দোলন বরাবরই বিক্ষুব্ধ রাজনীতির প্রেরণা।

অবস্থাদৃষ্টে ‘নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে সাফাই মোদির’। তাঁর কথা, নির্যাতিত জনসংখ্যাকে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে এ আইন। কিন্তু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝতে কারো বাকি থাকে না। তাই ভারতজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ মিছিল। ‘ভারতে কোনো বন্দিশিবির নেই’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ছাত্র-ছাত্রীরা জানে, বিরোধী রাজনীতিকরা বোঝেন—কোথাকার জল কিভাবে কোথায় গড়াচ্ছে।

তাই ভারতজুড়ে ছাত্র-নাগরিক সবাই মিলে ১০ দিন ধরে কারফিউ-১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণে চালাচ্ছে আন্দোলন। এ পর্যন্ত এ আন্দোলনে নিহত ২৩। মানুষ নির্ভয়, বেপরোয়া। এমনটা কি ভেবেছিলেন মোদি-অমিত সিন্ডিকেট? শুরুতে মমতার ওপর সব দায় চাপিয়ে ভারত-প্রশাসন ভেবেছে, দুদিনেই সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলা হবে। কিন্তু আন্দোলন চলছে তীব্রভাবেই।

মোদির আহ্বান আইন মেনে নেবার। কেউ তা মানছে না। ‘ধরনায় বসছে গান্ধী পরিবার। বিজেপিশাসিত রাজ্যে হতাহত বেশি।’ মোদি সরকার নানাভাবে আন্দোলনের প্রচারে, বিস্তারে বাধা সৃষ্টি করছে। টিভিতে-অনলাইনে সর্বত্র। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিক্ষোভের বিস্তার ঘটছে রাজ্য থেকে রাজ্যে, শহর থেকে শহরে।

সর্বশেষ খবরে প্রকাশ : ‘দাবি একটাই, আইন বাতিল করো’। মুম্বাই, বেঙ্গালুরু থেকে একাধিক শহর—বাদ নয় লখনউ কিংবা কেরালা। এক কথায় গোটা ভারত বিক্ষুব্ধ। এর মধ্যে চমকপ্রদ খবর : প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শর্মিষ্ঠা আটক। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মের ভিত্তিতে প্রণীত নাগরিক আইন সংবিধানবিরোধী।

অমিত শাহ তাঁর বিপরীত যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, এ আইন নির্যাতিত শরণার্থীদের পক্ষে, তাই মানবিক। কিন্তু কাউকে দীর্ঘদিনের স্থায়ী বসতি থেকে অনির্দিষ্ট যাত্রায় বের করে দেওয়া কি অমানবিক নয়? কিন্তু এরই মধ্যে ভারতীয় বিচারভুবনে কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। তার প্রমাণ রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায়, ঝুলন্ত ফেলানী, নাগরিক আইনবিরোধী রিট আপাতত খারিজ। শেষ আশ্রয়টুকু (আদালত) প্রতিবাদীদের মিলবে মনে হয় না। কী করবে তারা?

তবু আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তারই একমাত্র ভরসা। আমরা অপেক্ষায়।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877