এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে আর শোধ করছেন না। ঋণদুর্বৃত্তদের অপকর্মের খেসারত গুনতে হচ্ছে গোটা জাতিকে। বলা চলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে, যার জন্য দায়ী কিছু বড় ঋণখেলাপি। তারা ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু আর ফেরত দিচ্ছেন না। আর এ বড় ঋণখেলাপির কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
আর গত বছরের মার্চে ছিল ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ অবলোপন, বারবার ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণ পুনর্গঠনের হিসাব মেলালে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১৫ বছরের জন্য ঋণ নবায়নের কথা বলেন। যদিও পরে তা সার্কুলার করে ১২ বছর করা হয়েছে। এসব কারণে যেসব ব্যবসায়ী নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, তারা আর ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এটা অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ বিতরণ ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশই খেলাপি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্চ শেষে সরকারি খাতের ৬ ব্যাংকের ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা ঋণের ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা খেলাপি। গড়ে ব্যাংকগুলোর ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে।
বেসরকারি খাতের দেশীয় ৪০টি ব্যাংকের ঋণ ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সাথে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে।
বিদেশী ৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মার্চ শেষে হয়েছে ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ৬ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণ খেলাপি। এসব ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল ৩৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি। এসব ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল ২৪ হাজার ৬০২ কোটি টাকা।
জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা এবং আদায় জোরদায় করায় খেলাপিঋণ তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমে ৯৩ হাজার কোটি টাকায় নেমেছিল। কিন্তু নবায়ন করা খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় আবার ওই ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এতে চলতি বছরে খেলাপি ঋণ আবার লাগামহীনভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো তাদের অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাই সেখানে ভালো অবস্থান দেখাতেই কূট কৌশল প্রয়োগ করে থাকে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা নবায়ন। আর বছরের শেষ সময়ে এসে এই সুবিধা দেয়া-নেয়ার প্রবণতাও বাড়ে। এ ছাড়া শেষ সময়ে ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়। কিন্তু বছরের শুরুতেই ঋণ পুনঃতফসিল যেমন কম হয়, তেমনি আদায় কার্যক্রমেও গতি থাকে না।
সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে (নিয়মিত) বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আড়াই বছরেই এ সুযোগ নেন দেশের বড় শিল্প গ্রুপ। এর আওতায় ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছিল। এর বাইরে বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেরা আরো ৬৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে। সবমিলে ওই সময় পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করা হয়ে। পরে ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এরকম ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এসব ঋণ গ্রাহকেরা যথাসময়ে ফেরত দিচ্ছে না। ফলে তা আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলত দুইটি কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। একটি খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়া এবং অপরটি দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া। গত ডিসেম্বরে বিশেষ সুবিধায় যেসব ব্যবসায়ী ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিলেন, ওই সব ঋণ আবার খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কারণ এ সময়ে ব্যবসাবাণিজ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। এর বাইরে ব্যাংকিং খাতে যেসব দুর্নীতি হয়েছে তার একটিরও বিচার হয়নি। বরং তাদের রক্ষায় আরো নীতিসহায়তা দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে যেসব নীতিমালা করা হয়েছে, এসবই ভুল। এতে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। সে কারণে কেউ টাকা দিচ্ছে না। ধীরে ধীরে এটি আরো খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। সুশাসনের ঘাটতি, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগি ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যাÑ এসব কারণে খেলাপি ঋণ না কমে ক্রমেই বাড়ছে।