বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
শাস্তি না হওয়ায় জামিন জালিয়াতি থামছে না

শাস্তি না হওয়ায় জামিন জালিয়াতি থামছে না

দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জাল-জালিয়াতির ঘটনা একের পর এক ঘটেই যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী দুটি জালিয়াতি ধরা পড়ার পর বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এসব কা-ে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষ হয় না; বিচারকাজ শেষ হতে এমনকি এক-দেড় যুগ পর্যন্ত পেরিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জামিন জালিয়াতির মামলায় জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায়, বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় এমন কা- থামছে না। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছেন, সুপ্রিমকোর্টে জামিন জালিয়াতির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে কিছু অসাধু আইনজীবী জড়িত। জামিন জালিয়াতির হাত থেকে কোর্টকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য আইনজীবীসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন আমাদের। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিষয়টি দৃশ্যমান না হওয়ায় বারবারই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তিনি বলেন, কিছু কিছু আইনজীবী মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তথ্য গোপন করে আসামির জামিন করান। তাদের ব্যাপারে আদালত যদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নেন, সনদ বাতিল বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না করেন, তা হলে এ ধরনের ঘটনা কমবে না।

তিনি যোগ করেন, এসব ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সেটি বার কাউন্সিলে পাঠান। কিন্তু বার কাউন্সিলের ট্রাইব্যুনাল যেহেতু বার কাউন্সিলেরই সদস্যদের দিয়ে গঠিত, তাই অভিযুক্ত আইনজীবীদের সে রকম বিচার হয় না। এ অবস্থায় হাইকোর্ট যদি মনে করেন যে, কোনো উকিল অসৎ বা প্রতারণামূলক কাজ করেছেন, তা হলে কোর্টকেই তার সনদ বাতিলের বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা আমার নিজস্ব অভিমত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাইকোর্টের দুই বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে কারামুক্তি পান ১৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার মামলার আসামি কক্সবাজারের মো. সাকের। এ ছাড়া সাড়ে ২৯ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানের মামলায় স্থগিতাদেশ নেন আসামি চট্টগ্রামের আবু আহমেদ।

২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ ওই জামিন ও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে এক আদেশে উল্লেখ করেন, বিশাল একটি চক্র বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে, যার তদন্ত প্রয়োজন। এর পর সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর রাজধানীর শাহবাগ থানায় এ জালিয়াতির ঘটনায় দুটি মামলা হয়। প্রথমে শাহবাগ থানার দুই এসআই মামলা দুটির তদন্ত করলেও ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে তদন্ত শুরু করে সিআইডি।

সিআইডির কোতোয়ালি ইউনিটের উপপুলিশ পরিদর্শক খান মোহাম্মদ বোরহান দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছর মে মাসে আদালতে আবেদন দাখিল করে মামলা দুটি তদন্ত করার দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দেওয়ার আবেদন জানান। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, তদন্তভার গ্রহণ করার পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিরা সরকারি কর্মচারী এবং তারা দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনকালে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং মামলা দুটি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ (সংশোধনী ২০১৬)-এর বিশেষ বিধান ৮(১)-এর মূলে সম্পূর্ণরূপে দুদকের শিডিউলভুক্ত। তদন্তকাজ সিআইডি কর্তৃক পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়। মামলাটির পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করতে দুদকে প্রেরণ একান্ত আবশ্যক। ওই আবেদন দাখিলের পর গত বছরের ২৪ মে ঢাকার একটি আদালত মামলা দুটির ডকেট দুদকে পাঠান। বর্তমানে এ দুই মামলায় তদন্ত করছে দুদক। প্রায় তিন বছর আগে ধরা পড়া বড় ধরনের এ জালিয়াতির মামলার তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি।

শুধু এটিই নয়, গত বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রামে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক মামলার দুই আসামির জাল জামিন আদেশ তৈরির ঘটনায় হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয় এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিটি। পরে এ ঘটনায় এক কর্মচারী বরখাস্তও হয়েছেন। মামলায় অন্যদের বিরুদ্ধে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। এ ছাড়া অক্টোবর মাসে একটি ঘটনার তদন্ত করে ১৭টি জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এসব ঘটনার বিচার কবে শেষ হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত নন কেউ। জানা গেছে, আসামিরা জামিন নেওয়ার ক্ষেত্রে মামলার ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দতালিকা দাখিল করছে। অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে সৃষ্ট জাল কাগজপত্র দেখিয়ে উচ্চ আদালতকে বিভ্রান্ত করে পক্ষে আদেশ নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব জালিয়াতির সঙ্গে কিছু আইনজীবী, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, মামলার তদবিরকারক ও আইনজীবীর সহকারীরা জড়িত থাকেন। এসব ঘটনা ধরা পড়ার পর বিচারপতিদের নির্দেশে ফৌজদারি মামলা হচ্ছে।

এ ধরনের জাল-জালিয়াতির অভিযোগে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়ের করা প্রায় অর্ধশত মামলার বিচার চলছে ঢাকার নিম্ন আদালতে। এসব মামলার মধ্যে ২০০২ সালে দায়ের হওয়া মামলাও রয়েছে। একটি জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার যদি এক-দেড় যুগ ধরে চলে তা হলে মামলার সাক্ষীসহ অনেক কিছুই হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর এই বিচার বিলম্বিত হওয়ার নেপথ্যে অনেক সময় জালিয়াতচক্রেরও হাত থাকে বলে মনে করেন তারা।

সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, আমরা এখন জাল-জালিয়াতির ঘটনায় বেশ সচেতন বলেই এসব ঘটনা বেশি বেশি ধরা পড়ছে।

জাল-জালিয়াতির মামলার বিচার বিলম্বের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা আদালতের বিষয়। তবে বিচার বিলম্বের বিষয়টি দূর করতে আমাদের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জাল-জালিয়াতির মামলাগুলোর মনিটরিং করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আশা করছি শিগগির এসবের বিচার দৃশ্যমান হবে। সাম্প্রতিককালের বড় দুই জালিয়াতি এক. গত ২৭ মে হাইকোর্ট প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবা আটকের মামলায় জাল নথি দাখিল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করায় আসামি মো. সালেহ আহমেদ, মামলার দুই তদবিরকারকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। ১৯ মে আসামি সালেহ আহমেদের জামিন শুনানিকালে এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। ২০১৫ সালের ২০ জুন ৬ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ ৭ লাখ টাকা জব্দ করে র‌্যাব। এ ঘটনায় পরদিন ফেনী মডেল থানায় ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলায় কারাবন্দি সালেহ আহমেদ জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।

আবেদনে বলা হয়, ওই ইয়াবা উদ্ধারের সময় টেকনাফ মডেল থানার একটি মামলায় আসামি কারাগারে ছিলেন। ফলে ইয়াবা পাচারের যে অভিযোগ, এর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইউসুফ মাহমুদ মোরসেদ বলেন, যে মামলার কথা বলা হয়েছে ওই মামলায় আসামি জামিনে ছিলেন। আসামিপক্ষ থেকে তার কারাগারে থাকার যে আদেশের অনুলিপি দাখিল করা হয়েছে তা জাল। পরে নথি পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট জালিয়াতির সত্যতা পেয়ে আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন মাহাবুবা হক। দুই. মাগুরায় একটি জোড়া খুনের মামলার আসামি মোয়াজ্জেম হোসেন জাল নথি দিয়ে হাইকোর্ট থেকে গত ১৭ এপ্রিল জামিন নেন। বিষয়টি নজরে আসায় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের বেঞ্চ আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য মাগুরার পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।

গত ২২ মে হাইকোর্ট আসামি মোয়াজ্জেমের জামিন বাতিল করেন। পাশাপাশি মোয়াজ্জেম ও মামলার তদবিরকারক মনিরুজ্জামানকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন। আর মোয়াজ্জেমের আইনজীবী জাফর আলী খানকে জালিয়াতির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেন আদালত। আগামী ১৯ জুন এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877