ফেনীর মাদ্রসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকা-ে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনে এখনো গ্রেপ্তার হননি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গত ২৭ মে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এর পর থেকেই পলাতক জীবনযাপন করছেন ওসি মোয়াজ্জেম। পালিয়ে থাকার কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করতে সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তবে ওসির পালানোর খবর আইনের শাসনের জন্য অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ঈদের ছুটির পর গতকাল প্রথম কার্যদিবসে সচিবালয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘কেউ পলাতক হলে তাকে খুঁজে বের করতে সময় লাগে। এ কারণেই সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। নুসরাত হত্যাক-ের ঘটনায় তার (মোয়াজ্জেম) বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে। সে যতটুকু অপরাধ করেছে, সে অনুযায়ী তার বিভাগ এবং আদালত ব্যবস্থা নেবে। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা মনে করি, কেউ আইনের বাইরে নয়। সে ওসি হোক আর যে কোনো ধরনের কর্মকর্তা হোক, বা যেই হোক; জনপ্রতিনিধিও যদি হয়, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। সে পলাতক হলেও রক্ষা নেই।’
মোয়াজ্জেমকে ধরতে অভিযান চলছে বলেও জানান আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মে পরোয়ানা জারি করেন।
অন্যদিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে লুকোচুরির পর এখন পুলিশ বলছে, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন পালিয়ে গেছেন। জানা গেছে, ৩১ মে পরোয়ানার চিঠি ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছায়। যদিও পুলিশ সুপার কাজী মনির-উজ-জামান বারবার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকেন।
একপর্যায়ে ৩ জুন রাতে পরোয়ানা হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। এর দুদিন পর বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে সেই পরোয়ানা পাঠানো হয় রংপুর রেঞ্জে। এখন আবার রংপুর রেঞ্জ বলছে, কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি। এ বিষয়ে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দেবদাস ভট্টাচার্য জানান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রংপুরে এসেছে। কিন্তু মোয়াজ্জেম হোসেন অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত। পরোয়ানাটি সোনাগাজী থানার ওসির কাছেও পাঠানো হয়েছে। কেননা রংপুরে পাঠানোর ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণ করা হয়নি। বিধি মোতাবেক কাজ করার জন্য তিনি ফেনীর পুলিশকে জানাবেন।
এদিকে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের পালিয়ে যাওয়ার যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, বহুল আলোচিত এ হত্যাকা-ে ওসির ভূমিকার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে পুলিশ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রীতিমতো অশনিসংকেত।
গতকাল রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানায় টিআইবি। বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জেনেছি, পরোয়ানা জারির পর তা ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয় হয়ে রংপুর রেঞ্জে পৌঁছতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে যায়। এখন আবার রংপুর রেঞ্জ বলছেÑ কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি। আর এ সুযোগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন পালিয়ে গেছেন বলে জানানো হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে যেখানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক করাই স্বাভাবিক, সেখানে বহুল আলোচিত একটি মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে এ ধরনের দৃশ্যমান ব্যর্থতার ফলে যৌক্তিকভাবেই নুসরাত হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে পুলিশের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’
এর আগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্র থেকে সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসির অব্যাহতিও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নুসরাত হত্যাকা-ে আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং হত্যাকারীদের সুরক্ষা প্রদানে যোগসাজশের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে। এর পরও অভিযোগপত্রে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে কিনা, বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হওয়ায় তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে কিনা; আমরা সেই প্রশ্ন তুলেছিলাম। এখন তার পালিয়ে যাওয়ার খবরে আমাদের সেই আশঙ্কা আরও জোরালো হলো। ঘটনাপ্রবাহ থেকে তাকে কার্যত পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক।’
নুসরাত হত্যাকা-ে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আবারও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা গভীরতম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমন অবস্থায় পুলিশ বাহিনীর কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ভূলুণ্ঠিত হবে।’