এমএ খালেক (অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক): বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠককালে অন্যদের মধ্যে ঋণ হিসাব অবলোপনসংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে, যা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তারা দাবি করেছেন, কোনো ঋণ হিসাব খেলাপি হয়ে পড়ার পরপরই তা অবলোপন করার সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ দাবি প্রত্যাখ্যান বা মেনে নেওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়নি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, দাবিটি যেহেতু সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়নি; তাই আগামীতে তা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হতে পারে। কারণ একটি ঋণ হিসাব খেলাপি হয়ে পড়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তা অবলোপন করা হলে ব্যাংকিং সেক্টর খেলাপি ঋণমুক্ত হতে পারবে। কর্তৃপক্ষও চাইছে, আগামীতে ব্যাংকিং সেক্টর যেন খেলাপি ঋণমুক্ত হতে পারে। উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নতুন নীতিমালার আলোকে খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করেছে। ইতোপূর্বে একটি লোন অ্যাকাউন্ট মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে এবং সেই ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হলে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের পর বিশেষ শর্তাধীনে সেই ঋণ হিসাবকে অবলোপন করা যেত। সম্প্রতি জারিকৃত নতুন সার্কুলারের মাধ্যমে ঋণ হিসাব অবলোপনের সময়সীমা ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৩ বছরে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের শর্তও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে। ফলে ঋণ হিসাব অবলোপন আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত ব্যাংকিং সেক্টরে মোট ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। একই সময়ে দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। এছাড়া মামলাধীন প্রকল্পগুলোর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। অবলোপনকৃত ঋণ, মামলাধীন প্রকল্পগুলোর কাছে পাওনা ঋণাঙ্ক এবং পুনঃতফসিলিকৃত ঋণাঙ্ক খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয় না। এ নীতিমালাগুলো মূলত খেলাপি ঋণের ভয়াবহতাকে কমিয়ে দেখানোর জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইতোপূর্বে ঋণ হিসাব অবলোপনসংক্রান্ত নীতিমালা সহজীকরণ করা হলে তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়। কিন্তু সেই সমালোচনায় কেউ কর্ণপাত করেননি। ঋণ হিসাব খেলাপি হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অবলোপন করার সুযোগ দেওয়ার যে দাবি উত্থাপিত হয়েছে তার যৌক্তিকতা নিরূপণের আগে ঋণ হিসাব অবলোপন বলতে আমরা কী বুঝি, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ‘ঋণ হিসাব অবলোপন’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অনেকের মনেই ঋণ মাফ করে দেওয়া বা মওকুফ করে দেওয়ার মতো একটি আবহের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আমরা মনে করি, ঋণ হিসাব অবলোপন অর্থই হচ্ছে সেই ঋণের দাবি ত্যাগ করা। কিন্তু আসলে এটা মোটেও ঠিক নয়। ঋণ হিসাব অবলোপন অর্থ কোনোভাবেই পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করা নয়। খেলাপি ঋণাঙ্ককে ব্যাংকের মূল লেজার থেকে সরিয়ে অন্যত্র সংরক্ষণ করাকেই ঋণ হিসাব অবলোপন বলা হয়। যেহেতু অবলোপনকৃত ঋণের কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ থাকে বলে এ হিসাব কোনো কিস্তি আদায় হলে, তা সরাসরি মুনাফা হিসেবে গণ্য হয়। অবলোপনকৃত ঋণ সবসময়ই ব্যাংকের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে বিরাজ করে। কোনো ব্যাংকই চাইতে পারে না তাদের অবলোপনকৃত ঋণাঙ্কের পরিমাণ বেশি হোক। অবলোপনকৃত ঋণ ব্যাংকের সম্পদ নয়; কিন্তু এজন্য ব্যাংকের দায়িত্ব কোনোভাবেই কম নয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোনো ব্যক্তির তিন ছেলে। এর মধ্যে দুজন সুস্থ-স্বাভাবিক এবং একজন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। বাইরে থেকে কোনো অতিথি এলে ভদ্রলোক তা সুস্থ দুই ছেলেকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিবন্ধী ছেলেকে ঘরে আটকে রাখেন, যাতে অতিথিদের বিরক্ত করতে না পারে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেটি অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। অথবা তার প্রতি পরিবারের কোনো দায়িত্ব থাকে না। শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেটি অস্তিত্ববান; কিন্তু প্রদর্শিত নন। অবলোপনকৃত ঋণও ঠিক তেমন। এ ঋণের জন্য ব্যাংকের দায়বদ্ধতা আছে; কিন্তু ব্যাংক এটা প্রদর্শন করে না। ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, প্রদত্ত ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে নিয়মিত আদায়ের ব্যবস্থা করা। অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করা নয়। ব্যাংক কর্মকর্তারা যেমন তাদের ক্ষমতাবলে ঋণদান করতে পারেন, তেমিন সেই ঋণের কিস্তি নিয়মিতক আদায় করাটাই তাদের একান্ত দায়িত্ব। কোনো কারণে সেই দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হলে তার দায়ভার তাদেরই গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালনা করে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থে। এ জন্য তাদের উচ্চ বেতন-ভাতা এবং সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তারা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে সেজন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত ব্যাংকিং আইনে বেশকিছু সংশোধন করা হয়েছে। এসব আইনি সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার অবকাশ রয়েছে। যেসব আইনি সংস্কার করা হয়েছে, তা মূলত ঋণখেলাপিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। ঢালাওভাবে এমন কোনো আইন প্রণয়ন অথবা সংস্কার করা উচিত নয়, যা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা করে। উল্লেখ্য, ঋণখেলাপিদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি হচ্ছে প্রকৃত ঋণখেলাপি। যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা প্রতিকূলতার কারণে গৃহীত ঋণ সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারেন না, এরাই হচ্ছেন প্রকৃত ঋণখেলাপি। এদের নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে, প্রয়োজনে নতুন করে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা যেতে পারে। এদের আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান করে তোলা গেলে তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবেন। আর একশ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই ঋণ পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এরা খুবই মারাত্মক ধরনের এবং ব্যাপক ক্ষমতাবান। এদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া উচিত নয়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনেকেই বলেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারণ আইন তাদের মৃত্যুদ- দেবে না। বড়জোর তাদের জেল-জরিমানা হতে পারে। মূল উদ্যোক্তা বা ঋণগ্রহীতা তার প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্যুৎ কিংবা কারাবন্দি হলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তাদের কোনোভাবেই কঠোর শাস্তির আওতায় না এনে নিরাপদ প্রস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এ যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের বেশিরভাগই ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ অন্য কাজে ব্যবহার করেছেন। শিল্পকারখানা স্থাপনের নামে ঋণ নিয়ে অনেকেই বিদেশে পাচার করেছেন। কাজেই শত সুযোগ দেওয়া হলেও তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবেন না বা করতে পারবেন না। ১৬ মে, ১৯ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ এবং এক্সিট পলিসি ঘোষণা করে। এ নীতিমালার আওতায় একজন ঋণখেলাপিকে তার খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এককালীন পরিশোধের মাধ্যমে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেওয়া হয়। পুনঃতফসিলিকরণকৃত ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এ বিরল সুযোগ দেওয়ার পরও বড় বড় ঋণখেলাপি তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের জন্য তেমন একটা এগিয়ে আসেনি। প্রাথমিক পর্যায়ে এ নীতিমালার আওতায় ৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৮৩৫টি আবেদনপত্র পাওয়া গিয়েছিল। এদের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আবদেনকারীদের মধ্যে বৃহৎ ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল খুবই কম। অর্থাৎ বৃহৎ ঋণখেলাপি, যারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুযোগ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি। কারণ তারা জানেন, ঋণের টাকা ফেরত না দিলেও কিছুই হবে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে অন্য পক্ষ মনে করছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আর কোনো সুযোগ না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ কঠোর ব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। অনেকেই এটাও বলছেন, ইতোপূর্বে বেশ কয়েকজন বৃহৎ ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে আদালত তাদের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দিয়েছেন। তারা বর্তমানে জেলে অবস্থান করছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ঋণ পরিশোধ করেননি। শুধু জেল দিয়ে একজন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে শায়েস্তা করা যাবে না। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থাও আমাদের সামনে রাখতে হবে। ১৯৯১ সালের ২০ মে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে ১৭১ জন বৃহৎ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছিল। তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন আড়াই কোটি টাকা। সেই তালিকা প্রকাশের সময় বলা হয়েছিল, আগামীতে আরও ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশিত হবে এবং ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হবে। কিন্তু সেই অঙ্গীকার রক্ষা করা হয়নি। সেই অঙ্গীকারের অনুসরণে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। চীনে একসময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে তারা ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিমান টিকিট প্রদান বন্ধ করা হয়। আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে তারা খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই মুক্তি পায়। আমাদের দেশের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।