সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন

প্রাথমিকের শিক্ষকেরা বাঁচবেন কী নিয়ে?

প্রাথমিকের শিক্ষকেরা বাঁচবেন কী নিয়ে?

প্রবাদ আছে ‘বাপে জন্ম দেয় ভূত আর শিক্ষকে জন্ম দেয় পুত’। অর্থাৎ, সন্তান জন্ম দিলেই মানুষ হয় না, তাকে মানুষের যোগ্য করে গড়ে তোলেন শিক্ষক। অভিধান মোতাবেক পুতের অর্থ, ‘নবরূপে উত্তীর্ণ প্রদান তাড়িত হয় যাহাতে।’ বা ‘আপন দেহমনের অংশ প্রয়োগ করিয়া মানুষ যাহা কিছু উৎপাদন করে।’ সেই পুতের জন্মদাতা শিক্ষকেরা গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীতে জড়ো হয়েছিলেন। চাওয়া বেশি কিছু নয়। সামান্য গ্রেড বদল। কিন্তু সেই পুলিশরূপী পুতদের হাতেই খেলেন বেধড়ক মার। কী এক অদ্ভুত ব্যবস্থা, যেখানে জন্মদাতারা পুতদের হাতে মার খান। অথচ এই পুলিশ পোশাকের নিচের ছাত্রটি এখনো শিক্ষককে দেখে সালাম করেন। কিন্তু যখন তারা পুলিশ, তখন তারা সরকারের হুকুম তালিমের বাহিনী। সরকার যদি বিরূপ হয় শিক্ষকের প্রতি, তখন পুলিশের আর অন্য রকম আচরণের সুযোগ কই?

একই দিনে ক্রিকেটাররাও দাবি-দাওয়া তুলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নেওয়া হয়েছে। ৩০ তারিখের ভোটের সাংসদ ক্রিকেটার মাশরাফিই তো কিছুদিন আগে বলেছিলেন, খেলা একটা বিনোদন মাত্র। প্রাথমিক শিক্ষা তবে বিনোদনেরও নিচে? কবি বৃথাই লিখে গেছেন, ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার/ দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার?’

জিডিপিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ১৩তম। পেছনে ফেলেছে সিঙ্গাপুর-হংকংকেও। কিন্তু শিক্ষা খাতে ব্যয়ের দিক দিয়ে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সর্বনিম্নে। যাঁরা আইনি ও বেআইনিভাবে বিত্তবান হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কানাডার বাসিন্দা হওয়ার দৌড়ে। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে নাগরিকত্ব নিচ্ছেন। কিন্তু জনগণের সন্তানদের যাঁরা গড়ছেন, তাঁরা ঢাকার রাস্তায় মার খান।

২.
প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষক স্নাতক-স্নাতকোত্তর। উপরন্তু সিইনএড ও ডিপিইএড। ১০ম গ্রেডটি দ্বিতীয় শ্রেণির আর ১১তম গ্রেডটি কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির। এইটুকুই তাঁরা চেয়েছিলেন। তাও আবার যাঁরা শিক্ষকতায় ১০ বছর অতিক্রম করেছেন, তাঁদের জন্য নয়। দরকার মূলত নতুনদের। এই নতুনেরা প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে কেউ কেউ প্রধান শিক্ষকও হয়েছেন। একই ব্যাচেরই কেউ কর কর্মকর্তা, কেউ প্রশাসক হয়েছেন। কেউ কলেজের শিক্ষক হয়ে গবেষণার জন্য দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর প্রাথমিক শিক্ষক দিনে ৬-৭ টি ক্লাস নিচ্ছেন পাখির মতো শিশুদের। আসতে-যেতে সময় লাগছে অনেক। বাজার করার সময় নাই, নাই অর্থও। দূরের স্কুলে সন্তানকে সঙ্গে নেওয়াও মুশকিল। মানে সন্তানের খোঁজ নেওয়াও হয় না। এত শ্রমের পর শিক্ষক কি মানুষ থাকেন? মানুষ মানে তো শুধু খাওয়া-পরা না। পড়াশোনা, আড্ডা, সমাজ-রাজনীতি বোঝাও। এই জন্যই কি গল্প চালু আছে, ১০ বছর পর শিক্ষকদের সাক্ষী হিসেবে কোর্ট আমল নেন না। দোকানদার পাত্তা দেন না। মাছওলা দাম দেন না। যে চর-পাহাড়-হাওরে শিক্ষক তৃপ্তি নিয়ে খাবারটাও খেতে পারেন না, তাঁর কাছ থেকে আপনারা কেমন শিক্ষা আশা করেন?

৩.
অতিসম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পদোন্নতি বিষয়ে মত দিয়েছেন। বলেছেন, এখন থেকে শিক্ষকেরা সচিব পর্যন্ত হতে পারবেন। মানে উপজেলা থেকে ৪/৫ জন পদোন্নতি পাবেন কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর। এতে কি কিছুর বদল হলো? কলেজগুলোর মতো পদোন্নতির ক্রম থাকতে হবে। আর তার ভিত্তি হবে গবেষণা, নতুন আইডিয়া প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ও ফলাফল। প্রাথমিক স্তরে গবেষণা একেবারে নাই। ট্রেনিংগুলোতে যাঁদের শিক্ষাপদ্ধতি আলোচনা করা হয়, সবাই বিদেশি। অথচ ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিশুদের মানসিক গড়ন ভিন্ন।

এই দেশেই যাদব পণ্ডিতের জন্ম হয়েছে। যাঁর পাটিগণিত বিখ্যাত। এ দেশের শিশুরা কেন মুখে মুখে জটিল অঙ্ক কষতে পারলেও তা লিখতে পারে না—একাডেমিক পর্যায়ে এই আলোচনা হয় না। এখানে যিনি গৎবাঁধা পদ্ধতিতে পাঠদান করতে পারেন, যন্ত্রের মত ৬-৭টি ক্লাস নিতে পারেন, তিনিই সেরা শিক্ষক। এরই মধ্যে হঠাৎ শিবরামে একজন নুরুল আলম স্যার জন্মান। মানে স্বাধীন ও সৃজনশীল শিক্ষকের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়। এমনকি যে শিক্ষক চরে শিক্ষকতা করার সময় কৃষকদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবেন, তাঁর জন্যও নয়। ইতিহাস জানায়, প্রাথমিক শিক্ষা যখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল, তখন মাস্টার দা সূর্য সেন থেকে মাওলানা ভাসানীর মতো শিক্ষকের জন্ম হয়েছে, যাঁরা জাতির বেদনায় জেগে উঠেছেন।

গত ২৩ তারিখের সমাবেশে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের নামে শোকজ গেছে। মানে ছুটির দিনে শিক্ষকেরা মিলিত হতে পারবেন না!

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877