বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের জালিয়াতির কারণে চাহিদার অতিরিক্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এসব বই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে বিক্রি হয় খোলাবাজারে। এমন দুর্নীতি ঠেকাতে আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর আগেই পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই করে চাহিদা নিরূপণ করছে এনসিটিবি। ফলে আগামী বছরের জন্য পাঠ্যবইয়ের চাহিদা কমে গেছে প্রায় ১০ কোটি। ফলে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যয় কমে যাবে, অপর দিকে বন্ধ হবে খোলাবাজারে বই বিক্রি।
সরকারি মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৩ মণ পাঠ্যপুস্তক মঙ্গলবার লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের পোনাহাটি বাজার থেকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিক্রির দায় সন্দেহের তীর কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের দুই কর্মচারীর দিকে। এভাবে বিনামূল্যের পাঠ্যবই খোলাবাজারে বিক্রি অনেকটা ওপেনসিক্রেট মতো চলে আসছে বিগত বছরগুলোতে। এর পেছনের কারিগরিদের ধরতে গত জানুয়ারি মাসে মাঠে নামে গোয়েন্দা সংস্থা। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা দেওয়া এবং খোলাবাজারে সেই বই বিক্রির সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে এনসিটিবি।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, কালোবাজারিতে পাঠ্যবই বিক্রিতে জড়িত রয়েছেন কিছু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তারা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে বরাদ্দের বেশি বই গ্রহণ করেছেন। এরপর বাড়তি বইগুলো অধিক মূল্যে বিক্রি করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এক শ্রেণির প্রধান শিক্ষকরাও এই সিন্ডিকেটে জড়িত। সারা দেশ থেকে আসা সেসব বই রাজধানীর নীলক্ষেত ও বাংলাবাজারে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে বিক্রি হয়। সিন্ডিকেট করে পাঠ্যবই বিক্রয়ের সঙ্গে এক শ্রেণির অসাধু ছাপাখানার মালিকও জড়িত। বেশি মুনাফা পেতে তারা পাঠ্যবই বিক্রি করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে প্রতিটি পাঠ্যবই ছাপাতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৫০ টাকা। সেগুলো বিক্রি করা হয় ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। আর দোকানে বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, সিন্ডিকেট করে খোলাবাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে একাধিক সংস্থা মাঠে নামে। এনসিটিবির মনিটরিং টিমও কাজ করছে। প্রিন্টারদের ডেকে এনে জবাব চাওয়া হয়েছে। বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানুয়ারি মাসে নীলক্ষেতের বেশ কিছু বইয়ের দোকানো অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে পাঠ্যবই পায়। কয়েকটি দোকান থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানো প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের চেয়ে আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ১০ কোটি বই কম ছাপা হবে। চলতি বছর ছাপা হয়েছিল প্রায় ৪০ কোটি ১৬ লাখ পাঠ্যবই। এবারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমে ৩০ কোটি ৫২ লাখে নেমেছে। পাঠ্যবইয়ের এ চাহিদা যাচাই চলছে এবং তা আরও কমতে পারে।
এক বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করেই প্রায় ১০ কোটি বইয়ের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে দুটি কারণ জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তারা জানান, গতবার অনাকাক্সিক্ষতভাবে কিছু অতিরিক্ত চাহিদা পাঠিয়েছিল অসাধু চক্র। এবার সেটা হতে দেওয়া হয়নি। আমরা এবার মাধ্যমিকের বইয়ের চাহিদা সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়েছি। এতে ছলচাতুরী তো কিছুটা কমেছে।
আরেকটি কারণ হলো গত বছর আমাদের মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির বই ছাপাতে হয়েছিল। কারণ হঠাৎ করেই নতুন কারিকুলাম বাতিল করে আগের শিক্ষাক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে চার কোটির বেশি বই ছাপাতে হয়েছিল। এবার কিন্তু মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির বই ছাপতে হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের সংখ্যাটা কমেছে। ফলে খরচও অনেকটা কমে আসবে।
চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাবর্ষের চার মাসের মাথায় এপ্রিলে সব বই বিতরণ শেষ হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ছাপানো এনসিটিবির সব বই যেন ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানের বর্তমান চেয়ারম্যান।
এনসিটিবির পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের পাঠ্যবই ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ছাপা শেষ করে দেশের সব উপজেলায় পৌঁছে দেওয়া হবে। আর মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো শেষ করা হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই। উপজেলা থেকে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখের মধ্যেই সব স্কুলে স্কুলে বই চলে যাবে। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া হবে।