শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ০৪:৪৮ অপরাহ্ন

দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ

স্বদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর আরপিও অনুযায়ী নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। ফলে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার অধিকার হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন মেরুকরণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় এ

মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পাশাপাশি আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি আওয়ামী লীগকে ঘিরে, অন্যটি বিএনপিকে ঘিরে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। তাদের মতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে গুম-খুন-নির্যাতনের মধ্যেও দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করা বিএনপি শেখ হাসিনার পতনের পর পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে উত্থান ঘটেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সংগঠন এনসিপির। মানুষের মনে বড় স্থান করে নিয়েছে দলটি। একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন থাকলেও তারাও পিছিয়ে নেই। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক আলোচনায় দল হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রস্থলে আছে বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি তাদের ইতিবাচক ইমেজ ধরে রেখে যদি পথ চলতে পারে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্রিত করতে পারে, তা হলে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একমাত্র দল হিসেবে এনসিপির আবির্ভাব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে দেশের স্বার্থে দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নামতে কার্পণ্য দেখাচ্ছে না এনসিপি। দাবি আদায় করেই তারা ঘরে ফিরছে। এতে করে জনমনে তাদের প্রতি আস্থাও বাড়ছে। তবে এনসিপির কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকা-ে তাদের নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে এনসিপি নেতৃত্বের। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ আছে। এ দলের নেতাদেরও আরও কঠোর হতে হবে। এর অন্যথা হলে আত্মগোপনে চলে যাওয়া আওয়ামী লীগ আরও ভয়ঙ্কররূপে ফিরে প্রতিশোধ নেবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত করায় দলটি কিন্তু শূন্য হয়ে যায়নি। একটি

দলের প্রকাশ্যে রাজনীতি করার পথ বন্ধ হলে বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। কার্যক্রম নিষিদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তে দলটির সাধারণ সমর্থকরা হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো এখনও বিদ্যমান। দলটির সক্রিয় সদস্য ও দলের প্রতি অন্ধবিশ^াসী কর্মীরা দলের যে কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। তারা সরকারের ভুল খুঁজবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভুল খুঁজবে এবং সুযোগ বুঝে মাঠে নামবে। তিনি বলেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দেওয়া হয়। পরে সেই মুসলিম আর যুক্ত করা সম্ভব হয়নি তৎকালীন অনেক বিদেশি শক্তি তা না চাওয়ায়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে এত অর্থবিত্ত এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের বিস্তর প্রভাব রয়েছে। সুতরাং তারা চেষ্টা করবে দেশে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করার, গোলোযোগ সৃষ্টি করার। এ জন্য সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের সাথে লড়াই করতে হলে আদর্শিক লড়াই করতে হবে।

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে বিশেষ করে যেসব নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে তার ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- আওয়ামী লীগ, বিএনপির ভোটার হার প্রায় কাছাকাছি। বরং যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, তাতে কাস্টিং ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম। আওয়ামী লীগের সমর্থনে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এবার রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির প্রতিপক্ষ কে হতে পারে, তা নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগের শূন্যতা পূরণে প্রস্তুত হচ্ছে তরুণদের নেতৃত্বে গড়া নতুন দল এনসিপি। তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মীদের মনোভাব যদি দুর্বল না হয়; তা হলে দলটির মধ্যে ফাটল ধরানো কঠিন হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের সব নেতা এখন পলাতক। এর পরও ভারত থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তারা কথা বলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এতে সফল হলে আগামী দিনে দেশের রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের শক্তি ও আক্রমণাত্নক মনোভাব দেখে সন্ত্রাস দমন আইনে জুলাই গণহত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। যার ফলে দলটি বর্তমানে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নিজেদের ভেতর ঐক্য ধরে রেখে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

রাজনীতি-বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ গভীর সংকটে। মিয়ানমারের রাখাইনে গ-গোল। ভারতের সাথে ‘ডেড লক’ অবস্থা। বিদেশি বিনিয়োগ নেই। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। এ সংকট অবস্থায় রাজনীতির যে ঐক্য দরকার ছিল, সেটা দেখছি না। বরং জুলাই আন্দোলনে যে ঐক্য দেখেছিলাম, সেই ঐক্যেও ফাটল ধরেছে। আমি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে রক্তপাত দেখতে পাচ্ছি; তালগোল অবস্থা দেখতে পাচ্ছি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে সাধারণ মানুষের মনেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। তাই সতর্কভাবে পথ চলতে হবে বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বর্তমানে সক্রিয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে। শুধু তাই নয়, জুলাই আন্দোলনের শক্তির মাঝে বিভেদ দেখা দিলেও আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ সুগম হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে নানা প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। বিএনপি মনে করছে, জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, ৫ আগস্টের পরপরই যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হতো, তা হলে আরও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যেত। কারণ তখন জুলাই আন্দোলনের শক্তির মাঝে একটা ঐক্য ছিল। কিন্তু সেই ঐক্যে কিছুটা হলেও চির ধরেছে। এখন বিএনপিসহ একটি পক্ষ দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে, আরেকটি পক্ষ সংস্কার ও বিচারের পর নির্বাচনের পক্ষে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে থাকতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বিএনপি। উপরন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য চাপ দিন-দিন বাড়ছে।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া কী, সেটা দেখতে হবে। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের সব শক্তিকে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ এখন আমাদের সব কর্মসূচিতে প্রবেশ করে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাতে পারে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সংগঠিত হওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করবে, তত দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। নির্বাচন বিলম্ব হলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো সংবাদ