গত ৩ মে, শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চার দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। চার দাবির একটি দাবি হচ্ছে নারী সংস্কার কমিশন বাতিল বিষয়ে। গত ১৯ এপ্রিল কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রতিবেদন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করার পর থেকে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি হচ্ছে প্রতিবেদনটি ঘিরে। কিন্তু সমালোচনাতেই শুধু তা থেমে থাকেনি বরং হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে তারা চার দফা দাবিতে ২৩ মে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিরও ঘোষণা দিয়েছে। নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে তাদের তীব্র সমালোচনা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আলোচনার পাশাপাশি নারী কমিশনের প্রতিবেদনটি আসলে কেমন হয়েছে তা পর্যালোচনা করাও জরুরি।
প্রতিবেদনটির ১৫টি অধ্যায়ে বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত ও জনজীবন নিয়ে আলোচনা ও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়েই নারীদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন বিষয় নিয়েও সুপারিশ করা হয়েছে, যা প্রতিবেদনটিকে জটিল করে তুলেছে।
বাস্তবিক অর্থে আমরা যদি ধরে নিই যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ আর এক বছর ক্ষমতায় আছে, তবে তাদের পক্ষে এই প্রতিবেদনের বেশির ভাগ সুপারিশই নানা কারণে পূরণ করা সম্ভব নয়। যেমন তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করা অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন করা, হিন্দু ব্যক্তিগত আইন সংস্কার করা, বৈবাহিক ধর্ষণ কিংবা যৌন পেশাকে স্বীকৃতি দেওয়া—এই প্রতিটি সুপারিশই বাংলাদেশের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংবেদনশীল বিষয় যা পরিবর্তন বা পরিমার্জনের আগে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি আলোচনার দাবি রাখে। কমিশনের সদস্য নিয়োগ যদি লিঙ্গ ও দক্ষতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতো, তাহলে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা বিচারে নানামুখী আলোচনার সুযোগ থাকত।
৩. অন্যান্য কমিশনের সঙ্গে এই কমিশনের পার্থক্য হলো, অন্য কমিশনগুলো মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য গঠিত, কিন্তু এটিই একমাত্র কমিশন, যা ব্যক্তি বা মূলত নারীদের জীবন ও জীবিকাসংক্রান্ত নানা বিষয় উন্নয়নের জন্য গঠিত। আর তাই ‘সম-অধিকার’ নিয়ে আলোচনা ও বাস্তবায়ন কখনোই পুরুষদের মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ, আমরা আলাদা কোনো ‘নারী রাষ্ট্রে’ বসবাস করি না।
শুধু সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে নয়, সংযুক্তিতে দেখা যায় যে বিভিন্ন পরামর্শ সভায়ও একই অবস্থা বিদ্যমান। যেমন সংযুক্তি ২-এ (পৃ.১৯২) বিশেষজ্ঞ ও পর্যালোচকদের তালিকায় ২০ জনের মধ্যে ২০ জনই নারী। কিংবা সংযুক্তি ৮.৬-এ (পৃ.২৬৫) এনজিও প্রতিনিধিদের পরামর্শ সভায় ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী ও ৩ জন পুরুষ অংশ নেন। সংযুক্তি ৮.১২-তে (পৃ.২৭৫) খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান ও আইন সমতাবিষয়ক সভায় ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জন নারী ও ১ জন পুরুষ অংশ নেন।
এই পরিসংখ্যান উল্লেখের অর্থ এই নয় যে এসব বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা নারীরা করতে পারবেন না। বিষয়টি হলো এ ধরনের আলোচনায় বহুমাত্রিক বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্তি ভীষণ জরুরি ছিল।
যেমন ধরুন, অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন তৈরি করলে নারী লাভবান হবেন ঠিকই; কিন্তু পুরুষদের ধর্ম স্বীকৃত অংশ তো কমে যাবে। কিংবা বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিলে, পুরুষেরাই তো আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবেন। এ কথার অর্থ তো এই নয় যে, এই সুপারিশগুলো আলোচনার যোগ্য নয়। কিন্তু এগুলো সবই দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাপার। যেকোনো সরকারের আমলে এ ধরনের আইন প্রণয়নের আগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোচনার মাধ্যমে এই ধারণাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পুরুষদের বাদ দিয়ে বা বিপক্ষ শক্তি বানিয়ে এই সমাজে কেন, কোনো সমাজেই সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এমন ভাবনা বাস্তবসম্মতও নয়। কারণ, লড়াইটা তো পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতিবেদনের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে গড় সমতা’, যাকে নেতিবাচক ও আপত্তিকর হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ আছে।
৪. এ ছাড়া সুপারিশমালা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেক সুপারিশ কেবল সময়সাপেক্ষই নয়, আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যেমন অভিন্ন পারিবারিক আইন ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই পরিবারের ভাই-বোনদের কেউ শরিয়া আইনের মাধ্যমে আর কেউ অভিন্ন আইনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি চাইলে তার সমাধান কী? অথবা সমান সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমান দায়িত্বও প্রত্যেক নারী পালন করবেন কি না, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। যৌন পেশাকে পেশা হিসেবে বিবেচনা ও শ্রম আইনে স্বীকৃতি দিলে তাঁদের নিয়োগকর্তা কে হবেন বা কে বেতন দেবেন, সে সম্পর্কে বলা নেই। এ ছাড়া সংসদীয় আসনসংখ্যা ৬০০ তে বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সংসদ ভবনের সে ধারণক্ষমতা আছে কি না বা ৬০০ সদস্যের বেতন-সুবিধা প্রদানসহ উন্নয়ন বাজেটের মতো সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়েও কোনো আলোচনা নেই।
প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন প্রান্তিক নারী, যেমন অভিবাসী, আদিবাসী বা বিভিন্ন জনজাতি ও প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার নিয়ে সুপারিশ এসেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক বিষয়। একটা বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশে শুধু কওমি মাদ্রাসার আওতায় এক হাজারের বেশি মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে তিন লাখের বেশি ছাত্রী পড়াশোনা করে এবং ৬ হাজারের বেশি নারী শিক্ষকতা করেন। এই বিশালসংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্রী ও শিক্ষকদের অধিকার ও উন্নয়ন নিয়ে সুপারিশ সংযোজনের প্রয়োজন ছিল।
এ ছাড়া সংযুক্তি ৯২-এ (পৃ.২৯৩) যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির উল্লেখ নেই। জামায়াতে ইসলামীর নাম থাকলেও তাদের সঙ্গে কমিশন কোন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, প্রতিবেদন প্রকাশের পর জামায়াতে ইসলামী নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশের তীব্র নিন্দা করে প্রতিবেদন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি নতুন দল এনসিপির মুখপাত্ররা বিভিন্ন আলোচনায় নেতিবাচক মন্তব্যই করেছেন।
কমিশন বাতিলের আন্দোলনেও নারীবিবর্জিত চিত্র দেখতে পাই, যেখানে মূলত একই ভাবাদর্শের পুরুষদের উপস্থিতিই দৃশ্যমান। গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে তারা কোনো কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ও কাম্য হতে পারে না। ভোটের রাজনীতিতে তাদের এই অবস্থান কী প্রভাব ফেলে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সর্বশেষ বলতে চাই, নারীদের অধিকারবিষয়ক এই কষ্টসাধ্য প্রতিবেদন যাঁরা তৈরি করেছেন, তারা নিঃসন্দেহে অনেক পরিশ্রম করেছেন। কমিশন যে ৪৩৩টি সুপারিশ দিয়েছে, তার সব কটিই যদি পূরণ হতো, একজন নারী হিসেবে খুশিই হতাম। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার যে ফারাক, তা মাথায় রেখে এতগুলো সুপারিশ না করে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিসংগত ও বাস্তবসম্মত নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশমালা প্রদান করলে প্রতিবেদনটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারত।