রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:০০ অপরাহ্ন

উত্তরাঞ্চলে তীব্র ঠাণ্ডার পদধ্বনি

উত্তরাঞ্চলে তীব্র ঠাণ্ডার পদধ্বনি

স্বদেশ ডেস্ক:

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকা এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসায় রংপুরসহ এই অঞ্চলের ষোল জেলায় এবার স্বাভাবিক সময়ের দুই মাস আগেই শুরু হয়েছে শীত। দেখা দিয়েছে তীব্র ঠাণ্ডার পদধ্বনি। সন্ধ্যার পরপরই কুয়াশার চাদরে বন্দী হয়ে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। শুরু হয়েছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। এই অবস্থাকে ‘ডেঞ্জার’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলমান আবহাওয়ার পরিবর্তন না ঘটলে এবার শীতের তীব্রতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতে এই অঞ্চলের পৌনে এক কোটি হতদরিদ্র মানুষ চরম দুর্ভোগের দ্বারপ্রান্তে আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, কার্তিক মাসের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে ক্রমাগতই কাছাকাছি আসছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। কমছে বাতসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। এতে বাড়ছে আর্দ্রতার শতকরা হার। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসায় এবং সন্ধ্যায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এবার দুই মাস আগেই এই অঞ্চলে শীতে এসে গেছে। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এই অঞ্চলে শীত পড়তে শুরু করে। কিন্তু এবার কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া সহকারী আব্দুস সবুর জানান, গত ৫ নভেম্বর এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনিম্ন ২১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর্দ্রতা ছিল শতকরা সর্বোচ্চ ৯৬ সর্বনিম্ন ৫৬ শতাংশ। ৪ নভেম্বর ছিল সর্বোচ্চ ৩০.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনিম্ন ২১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর্দ্রতা শতকরা সর্বোচ্চ ৯৪ সর্বনিম্ন ৫৪ শতাংশ; ৩ নভেম্বর ছিল সর্বোচ্চ ৩১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনিম্ন ২১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর্দ্রতা শতকরা সর্বোচ্চ ৯৫ সর্বনিম্ন ৫৪ শতাংশ।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, এবার কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকেই রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা শুরু করেছে। ফলে শীত ও কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে আগে থেকেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমার কারণে শীত অনুভবের পাশাপাশি আগাম কুয়াশা পড়াও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এবার এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। আবহাওয়ার এই অবস্থার উন্নতি না হলে এবার তীব্রতর শীত পড়বে। যার পদধ্বনি ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। শীতের তীব্রতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করছেন এই আবহাওয়াবিদ।

সরেজমিন পাওয়া তথ্য মতে, এবার এই অঞ্চলে কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। মাগরিবের নামাজের আগেই বিস্তৃত জনপদে দেখা যায় কুয়াশার চাদর। ফলে এই অঞ্চলের নগর বন্দর, পাড়া মহল্লার আড্ডাস্থলগুলো এখন ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শীতের গরম কাপড় পরে চলাফেরা শুরু করে দিয়েছে। বাসাবাড়িতে লেপ কাঁথা বের করা হয়েছে। ভোরবেলাতেও কুয়াশার কারণে অনেক পরিবহন হেড লাইট জ্বালিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখছে।

উত্তরাঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কেনার তেমন একটা সামর্থ্য থাকে না। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দেয়া শীতবস্ত্রই তাদের ভরসা। অন্য দিকে সেন্টার ফর স্ট্যাটিক্সটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিএসডি) নামের একটি সংগঠনের জরিপে বলা হয়েছে, উত্তরের ষোল জেলায় সাড়ে আট হাজার বস্তিসহ প্রায় পৌনে এক কোটি অতিদরিদ্র মানুষের বসবাস। প্রতি বছরই শীতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়। চরম দুর্ভোগের মুখে পড়ে তারা। দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়।

ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসোর্স ইনস্টিটিউট-ইরি বাংলাদেশের কন্সালট্যান্ট ড. এম জি নিয়োগী নয়া দিগন্তকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার দুই মাস আগেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে শীতের তীব্রতা বাড়বে বহুগুণ। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতেও পারে। তিনি বলেন, এখনই শীত মৌসুমকে অগ্রাধিকার দিয়ে উত্তরাঞ্চলের জন্য সরকার পৃথক কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ না করলে এই পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ দীর্ঘ দিন থেকে অতিদরিদ্র মানুষ, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, এবার এই অঞ্চলে আগাম শীত নেমেছে। কিন্তু সরকারি তরফে শীত প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানার পর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় অতিদরিদ্র পরিবারগুলোতে। প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে।

উত্তরাঞ্চলের ডিসি অফিস সূত্রগুলো জানায়, এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের ডিসি অফিসগুলোর তত্ত্বাবধানে শীত মোকাবেলার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কম্বল বা শীতের কাপড় চেয়ে ওপরে কোনো আবেদন করা হয়নি। জেলাগুলোর ত্রাণ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর শীতের মৌসুমে এই অঞ্চলে সরকারিভাবে কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭২ হাজার। কিন্তু তা দিয়ে শীত মোকাবেলা করতে পারা যায়নি।

রংপুরের জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা এ টি এম শফিকুজ্জামান নয়া দিগন্তকে জানান, চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো বরাদ্দ দেয়নি। আমরাও কোনো চাহিদাপত্র পাঠাইনি। পরিস্থিতি বুঝে তার পর চাহিদাপত্র পাঠানো হবে।

শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব: রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল ও উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে প্রকাশ, আগাম শীত আসায় এসব হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি ক্লিনিক এবং লোকালয়ের হাতুড়ে ও পল্লী চিকিৎসকদের চেম্বারেও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তদের ৭০ ভাগই নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং মাথাব্যথার রোগী। এদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশই বৃদ্ধ ও শিশু। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: সুলতানুল আলম নয়া দিগন্তকে জানান, শীত আগাম আসায় এই অঞ্চলে নিউমোনিয়া, জ্বর সর্দি কাশিসহ শীতজনিত রোগের মাত্রা বাড়া শুরু হয়েছে। এমন রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877