স্বদেশ ডেস্ক: অনেকসময় দেখা যায়, বর্হিমুখী, মিশুকে মানুষটি হঠাৎ যেন পালটে যেতে থাকেন। নিজেকে সকলের কাছ থেকে গুটিয়ে নেন। চিকিৎসার মাধ্যমে কী সেগুলোর উপশম সম্ভব?
সিজোফ্রেনিয়া হল এমন এক মানসিক রোগ যাতে আক্রান্ত হলে রোগীর চিন্তাভাবনা, আবেগ, উপলব্ধি, ইচ্ছাশক্তি এসবের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এঁদের মধ্যে যাঁরা হ্যালুসিনেশন বা ডেলিউশন-এ ভোগেন তাঁরা নির্জন ঘরের মধ্যেও অন্যের কথা শুনতে পান, অন্যকে দেখতে পান, উদ্ভট আজগুবি ধারনের মধ্যে ডুবে থাকেন। আসলে প্রায়ই এঁরা বাস্তব জগত্ ছেড়ে এক অলীক জগতের বাসিন্দা হয়ে পড়েন। সিজোফ্রেনিয়ার সূচনা হয় সাধারণত কৈশোরের শেষ অথবা যৌবনের শুরুতে। চিন্তাভাবনায় অসঙ্গতি আসার জন্য লেখাপড়া বা কাজকর্মে আবনতি ঘটে। লোকজনের সঙ্গে এঁরা মেলামেশা কমিয়ে দেন। অনেকসময় দেখা যায়, বর্হিমুখী, মিশুকে মানুষটি হঠাৎ যেন পালটে যেতে থাকেন। নিজেকে সকলের কাছ থেকে গুটিয়ে নেন। নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য, পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও ক্রমশ: উদাসীন হয়ে যান। আর আবেগের বিশৃঙ্খলার জন্য এঁদের অন্যের ওপর মায়া-মমতা-ভালবাসাও যেন কমে যায়। চিঠিতে আপনার দিদির উপসর্গের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে, উনি সম্ভবত ‘ক্যাটাটনিয়া’ নামে এক ধরনের সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। এ রোগের লক্ষণই হল চলাফেরা এবং অঙ্গসঞ্চালনের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা। শরীরের নড়াচড়ার ক্ষমতা কমে যায়। হাঁটতে-চলতে-উঠতে-বসতে অস্বাভাবিক বেশি সময় লাগে। কোনও কিছু হাত দিয়ে ধরার সময়, তা সে জানলার গরাদ অথবা অন্য কারওর হাত, যাই হোক না কেন, এমন ভাবে তা আঁকড়ে ধরেনমনে হয় যেন হাত ছেড়ে দিলেই রোগীটি পড়ে যাবেন। ক্ষানিকটা মোমের পুতুলের মতো একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গীতে এঁরা দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারেন। হাতটা মাথার ওপর তুলে অথবা শরীরটা বেঁকিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে স্ট্যাচুর মতো বসে অথবা দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। জোর করে স্বভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রীতিমতো বাধা দেন এঁরা।
সম্প্রতি মানসিক রোগের যে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে তাতে ‘ক্যাটাটনিয়া’কে শুধুমাত্র সিজোফ্রেনিয়ার একটা বিশেষ ধরণ হিসেবে না ভেবে একেবারে আলাদা অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে কেউ যদি অটিজম, মাদক বা অবসাদে আক্রান্ত হন, তবে তাঁর মধ্যেও ক্যাটাটনিয়ার উপসর্গগুলো আলাদাভাবে আসতে পারে। জার্মানীর এক চিকিৎসক। কার্ল কালবাম, ১৮৭৪ সালে এই অসুখের কথা প্রথম বলেন। আগে এই রোগের চিকিৎসায় শকথেরাপীর বেশ চল ছিল। এখন অবশ্য নির্দিষ্ট ধরনের উত্কণ্ঠানাশক ওষুধ এই অসুখ সারাতে খুবই কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আমার মতে, আপনার দিদি সম্ভবত তাঁর পড়াশুনো শেষ হবার পর সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। এ অসুখ তাঁর ব্যক্তিসত্বাকেই বদলে দিয়েছে, ফলে তিনি আর আগের মতো রইলেন না। হাঁটাচলা স্লথ হওয়ার সঙ্গে কোনও কিছু বুঝতে , কাজ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। কোনও কাজের দায়িত্ব নেবার ক্ষমতাও কমে যায়। সেই সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক পরিবেশে ঠিকঠাক আচরণ করার ক্ষমতা এবং বাড়তি উত্কণ্ঠা। এমনকি উনি নিজের শরীর-স্বাস্থ্য-পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনত ছিলেন না। সচেতনার অভাবই সম্ভবত ওর নবজাত শিশুটির বর্তমান শারীরিক অবস্থার জন্য দায়ী।
আপনার দিদির যখন প্রথম অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছিল তখনই চিকিৎসা করাতে পারলে ভাল হত। তাহলে হয়তো আজকের এই অবস্থায় পৌঁছতে হত না। তবে চিন্তার কিছু নেই। সরকারি বড় হাসপাতাল ছাড়াও প্রতিটি জেলার সদর হাসপাতালে মনোরোগ-চিকিৎসার বিভাগ রয়েছে। এখানে প্রায় নিখরচায় মানসিক রোগীদের চিকিৎসা সম্ভব। যেহেতু ক্যাটাটনিয়া সহ সিজোফ্রেনিয়া রোগের উপশমে কার্যকরী ওষুধ সহজলভ্য। তাই ঠিকমতো চিকিৎসা করালে আপনার দিদি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবেন। তবে ওষুধের পাশাপাশি পরিবারের বা কাছের মানুষদের মেন্টাল সার্পোট দরকার। স্বামী এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের সহানুভূতি ওকে তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।