এমএ খালেক: ক্রেডিট সুসির বৈশ্বিক সম্পদ প্রতিবেদন, ২০১৯-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা সিএনএনের এক সংবাদে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী অতি বিত্তবানের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি চীনে বিত্তবানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। চীন যেমন অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি দেশটিতে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের ব্যবধানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় চীন ‘সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা’র লক্ষ্যে মনুষ্যসৃষ্ট সমতা বিধানের মতবাদ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করলেও এখন দেশটি সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা এখন একধরনের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করছে। অবশ্য তারা পশ্চিমা ধাঁচের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হুবহু অনুসরণ করছে না। তারা পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সমন্বয় বিধান করে সীমিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুসরণ করছে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা দ্রুততর হয়েছে। নতুন এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের সামর্থ্য অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে পেরেছে। কয় বছর আগে চীন জাপানের ৪৪ বছরের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে অতিক্রম করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি তারা পাসচেজিং পাওয়ার প্যারেটির (পিপিপি) বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে চীন অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে চলে যাবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। চীন আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই অবস্থায় চীনের সামাজিক বৈষম্য কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা অতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ক্রেডিট সুসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান যতই শক্তিশালী হচ্ছে দেশটির মানুষের সম্পদবৈষম্য ততই প্রকট আকার ধারণ করছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর বেশিরভাগই চীনে বসবাস করছে। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ দেশটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য প্রদর্শন করে চললেও তারা সামাজিক এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধনী ব্যক্তির বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থই যেন সোনার হরিণের সন্ধান পাওয়া। কিন্তু এখন সেই অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তির বেশিরভাগই চীনে বাস করছে। চীনে এ ধরনের লোকের সংখ্যা ১০ কোটি। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তাদের বিশ্বের ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে ৯ কোটি ৯০ লাখ জন। অবশ্য এ সংখ্যাগত দূরত্ব শিগগিরই আরও বিস্তৃত হবে। চীনের বিত্তবানের সংখ্যা অচিরেই আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। ১০ লাখ মার্কিন ডলারের মালিক, এমন লোকের সংখ্যা আবার যুক্তরাষ্ট্রেই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের এমন ব্যক্তির সংখ্যা ১ কোটি ৮৬ লাখ। চীনে এদের সংখ্যা ৪৪ লাখ। ব্যাংক ঋণের তুলনামূলক স্বল্প সুদ হার এবং রিপাবলিকান সরকারের কর হ্রাসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিত্তবান নাগরিকের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। চীনে শীর্ষ ১০ শতাংশ বিত্তবান মানুষের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি হলেও সাধারণভাবে নাগরিকদের সম্পদের ক্ষেত্রে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ গড়ে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৩৬৫ মার্কিন ডলার। চীনে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৫৮ হাজার ৫৪৪ মার্কিন ডলার। কোনো ব্যক্তিকে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনিক-শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত থেকে হলে নিট ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ থাকতে হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর ২০০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিচের দিকের ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল বিশ্ব সম্পদের ১১ শতাংশ। এখন তা ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ বেড়েছে। আগে দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলো সবার শীর্ষে ছিল এখন সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে চীন। চীন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে যতই তার অবস্থান শক্তিশালী করছে দেশটির বিত্তবান এবং বিত্তহীনের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য ততই বাড়ছে। এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা সার্বিকভাবে সমাজের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে উঁচুতলার মানুষকে কাতারে নিয়ে আসতে পেরেছে। অনেকেই আবেগের বশবর্তী হয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের সেøাগান দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করেন না, দারিদ্র্য বিমোচিত হওয়ার বিষয় নয়। বিত্তবান-বিত্তহীন আল্লাহর সৃষ্টি। তাই সমাজ থেকে চাইলেই দারিদ্র্যবিমোচন করা যাবে না। তবে আমরা যদি বিত্তহীনদের অধিকার এবং প্রাপ্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিশোধ করি, তাহলে তারা তুলনামূলক ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। আমাদের দেশের একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, তিনি ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামে পাঠাবেন। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা করতে গিয়ে তিনি নিজেই হয়তো মিউজিয়ামে চলে যাবেন। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি বলেছেন, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রহীনতার মাঝেও একটি দেশ বা জনপদের অর্থনৈতিক উন্নতি হতে পারে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। এমনকি চরম দারিদ্র্যও হ্রাস পেতে পারে। কারণ দুর্নীতিপরায়ণ এবং অগণতান্ত্রিক সরকারও তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধনে ব্যাপৃত হয়ে থাকে। অভিজিৎ ব্যানার্জির এ বক্তব্য অনেকেই সমালোচনা করছেন। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে পর্যালোচনা করি, তাহলে তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। একটি দেশ প্রচ- দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার মধ্যেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে। যেসব দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে সমর্থ হয়েছে তারা কি বলতে পারবে তাদের দেশে দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা নেই? দুর্নীতি এবং উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে। এমনকি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার মধ্যেও একটি দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারে। আমরা যদি ইরাক, লিবিয়া, মিশর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশের দিকে তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই? এসব দেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে একসময় চমক সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে সামরিক স্বৈরশাসনামলে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশগুলো প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করেছিল। সেই সময় অনেক গণতান্ত্রিক দেশ ছিল, যারা এসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। যারা সততাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে তারা অনেক সময় উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। অনেকেই আছেন, যারা উন্নয়ন কার্য সম্পাদন করেন ব্যক্তিগত ফায়দা অর্জনের জন্য। কাজ করা হলেই ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন করা যায়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। একসময় যারা বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল আজ তারাও বাংলাদেশেক ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যদি দেশের সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে না পারে, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকার সাফল্য অর্জন করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করবে। এতদিন আমরা নিজেদের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশ এতদিন ছিল একটি স্বল্পোন্নত দেশ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের এ অর্জন হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অর্জনগুলো কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আমরা কি দাবি করতে পারব, বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে? বঙ্গবন্ধু এক সময় দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় স্বর্ণের খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ আমরা কি চোরের খনি থেকে মুক্তি পেয়েছি? এর উত্তর নেতিবাচক। কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিঘিœত হয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং নির্দেশনায় দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে। এ অভিযানের ফলে আমরা সমাজের একটি নোংড়া চিত্র দেখতে পাচ্ছি। আমরা জানতাম দেশের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলের পরিচয় ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধভাবে। কিন্তু তার পরিমাণ যে এত বিপুল অঙ্কের, তা কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম? বাংলাদেশ সৎ এবং স্বচ্ছ লোকগুলো বড়ই অসহায়। দুর্নীতিবাজদের দাপটে তাদের টিকে থাকাটাই মুশকিল। যারা দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতি করে তাদের কোনো নীতি-আদর্শ থাকতে পারে না। তাদের একটি মাত্র পরিচয়, তারা দুর্নীতিবাজ। ইতোপূর্বে আর কখনোই কোনো দলীয় সরকার নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেনি। কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা না দিয়েই এ অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে দুর্নীতিবাজরা তাদের অবৈধ অর্থসম্পদ সরিয়ে নিতে পারেনি। বাংলাদেশে সামান্য কিছু পেশা ব্যতীত সৎভাবে কোটিপতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু প্রত্যেক পেশাতেই শত শত কোটিপতির সন্ধান পাওয়া যায়। একজন ওসমান গনি, যিনি বনখেকো নামে পরিচিত, তিনি তো সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। তিনি কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন? একজন সরকারি চাকরিজীবীর কি কোনোভাবেই শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ আছে? কিন্তু এমন অনেক চাকরিজীবী আছেন, যারা শত শত কোটি টাকার মালিক। একজন সরকারি চাকরিজীবী যখন ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে ব্যাংকের মালিক বনে যান, তখন বুঝতে বাকি থাকে না তার আয়ের উৎস কোথায়? আগে সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ মানুষগুলো লজ্জিত অবস্থায় চলাফেরা করত। আর এখন সৎ লোকগুলো আর্থিক দুর্বৃত্তদের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আগেকার দিনে কিছু কিছু চাকরি ছিল, যেখানে অসৎভাবে অর্থ উপার্জনের বিস্তৃত সুযোগ ছিল, সেসব পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমাজের ভালো কোনো পরিবার আত্মীয়তা করতে চাইতেন না। এখন এসব কিছু দেখা হয় না, পাত্রের অঢেল অর্থ থাকলে তার বংশ পরিচয় বা পেশার পরিচয় বিবেচ্য বিষয় হয় না। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না। কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তি লিখেছেন, অর্থ পাচার বন্ধ হলেই নাকি দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। এটা একটি অর্থহীন সংলাপ মাত্র। কারণ দুর্নীতির দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে অর্থ পাচার। যেহেতু দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থসম্পদ অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেই; তাই অবৈধ অর্থের নিরাপত্তার জন্য কিছু মানুষ তা পাচার করে থাকে। কাজেই অর্থ পাচার বন্ধ হলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। বরং দুর্নীতি বন্ধ হলেই অর্থ পাচার বন্ধ হবে। ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় দুটি জাতীয় বাজেটের অর্থায়ন করা সম্ভব। ক্যাসেনো কা-ের পর প্রকাশ হচ্ছে কারা কোন দেশে কত টাকা পাচার করেছেন। আমরা যদি দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো কি না জানি না। তবে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেকটাই কমে আসত।
সমাজে অভ্যন্তরীণ সুশাসন না থাকলে অবৈধ অর্থ আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই তাদের আখের গুছিয়ে নেন। সমাজে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলে আর্থিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি একই সঙ্গে বাড়ছে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের মধ্যে ব্যবধান। স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল সহনীয় পর্যায়ে। এখন তা প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বিশ্বের যেসব দেশে সড়ক এবং ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কেউ বলতে চাইছেন, আমাদের অভিজ্ঞতা কম বলে নির্মাণ ব্যয় বেশিÑএটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সমাজটাই কেমন যেন হয়ে গেছে। আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি। একজন মুদি দোকানি যদি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যেতে পারেন, তাহলে কে এ সুযোগ হারাতে চাইবেন? সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছেন তার সফল সমাপ্তির ওপর নির্ভর করছে আমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কেমন সমাজ রেখে যাব। এক সময় আমাদের বিতর্ক উঠেছিল, আমরা কি গণতন্ত্র চাই নাকি উন্নয়ন? আমরা আসলে গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দুটোই চাই। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা। আমরা যদি অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে দুর্নীতি এমনিতেই কমে আসবে। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব হচ্ছে সেই ব্যক্তির মতো, যিনি বাঁধের উজানে বসে পানি ঘোলা করছেন। আর ভাটিতে ঘোলা পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ভাটিতে পানি সেচে কোনোভাবেই ঘোলা পানির আগমন বন্ধ করা যাবে না। আমরা যেটা করতে পারি, তাহলে উজানে পানি ঘোলা করায়রত ব্যক্তিটিতে সমূলে উৎখাত করা। আমরা কি সেটা পারব?