সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:১১ অপরাহ্ন

দ্বিতীয় দফায় মোদি ও ভারতের ভবিষ্যৎ

দ্বিতীয় দফায় মোদি ও ভারতের ভবিষ্যৎ

২০১৯ সালের মে মাসের ৩০ তারিখে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বারের জন্য নতুন সরকার গঠন করলেন। দেশের হাজারটা সমস্যার সম্মুখীন তাঁকে হতে হবে। কিন্তু বিজেপি সূত্রে বলা হয়, আমাদের প্রধান কর্মসূচি হবে কংগ্রেসমুক্ত ভারত। এ জন্য যা কিছু করার সবই করতে হবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গসহ হিন্দিবলয়ের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে কংগ্রেস ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। হিন্দিবলয়ের অযোধ্যার রামমন্দিরের কাছাকাছি যেসব রাজ্য আছে, সেগুলোতে কংগ্রেসের ফল খুবই খারাপ হয়েছে। নাগপুর থেকে মোদি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, ১৩৫ বছরে জাতীয় কংগ্রেস আর ভারতবর্ষে প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতাসংগ্রামে কংগ্রেসের ভূমিকাও ধীরে ধীরে মুছে ফেলতে হবে। বস্তুত স্বাধীনতার পরই ১৯৫২ সালে জনসংঘের জন্ম। আর ১৯৮০ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির হাত ধরে জন্ম হয় বিজেপির। সুতরাং স্বাধীনতাসংগ্রামের বিষয় দেশবাসীকে আর নতুন করে বলা বা জানানোর প্রয়োজন নেই। হিন্দু মহাসভার দুই প্রতিষ্ঠাতা নেতা মহারাষ্ট্রের গোয়েলকা এবং উত্তর প্রদেশের দীনদয়াল উপাধ্যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আন্দামানের জেলে ছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস ঘাঁটলে একটা সত্যি কথা বেরিয়ে আসছে—তা হলো, এই দুই নেতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে দাসখত লিখে দিয়ে জেল থেকে মুক্তি পান। কমিউনিস্টদের মতো এঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের পাশে দাঁড়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৫ বছর আগে ১৯২৮ সালে বোম্বেতে আরএসএসের জন্ম হয়। সেই থেকে আরএসএসের বাড়বাড়ন্ত। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে। সেই নাথুরাম গডসকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করে এবার পূজা পর্যন্ত দেওয়া হয়। বিগত পাঁচ বছরের শাসনে স্বাধীনতাসংগ্রামের পুরোধা মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ—এঁদের নাম কার্যত মুছে ফেলেছে বিজেপি। বিজেপির সব শ্রেণির নেতারাই এখন ফিসফিস করে বলছেন, আর দেরি নয়, এই সুযোগে ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের ফল বের হতেই রাজ্যে রাজ্যে গেরুয়া বাহিনী বলছে, ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করার দোরগোড়ায় আমরা পৌঁছে গেছি, আর একটু ধাক্কা দিতে হবে, আর সেই ধাক্কার নেতৃত্ব দেবেন নাগপুরের মোহন ভগবত আর নতুন সরকারের মন্ত্রীরা, যাঁরা কংগ্রেসমুক্ত ভারত করার জন্য আস্ফাালন করছেন তাঁদের এর পরিণাম জানা নেই।

নির্বাচনে হারের ১০০ শতাংশ দায়িত্ব নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী দলের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সংস্থা ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেছেন।

ওয়ার্কিং কমিটি রাহুলের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু রাহুল এই লেখা পর্যন্ত পদত্যাগে অনড়। রাহুল সবচেয়ে আঘাত পেয়েছেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের আমেথি কেন্দ্র থেকে মোদি ঘনিষ্ঠ স্মৃতি ইরানির কাছে অল্প ভোটে হেরে গিয়েছেন। যদিও দক্ষিণ ভারতের কেরলের একটি কেন্দ্র থেকে তিনি কয়েক লাখ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। রাহুলের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশের লোকসভার নির্বাচনে মাত্র একটি আসন পেয়েছে। এই দুটি রাজ্যের আসন প্রায় ৫০-এর কাছাকাছি। এই হারের জন্য রাহুল প্রকাশ্যে সরাসরি দায়ী করেছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলটকে এবং মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথকে, মধ্য প্রদেশের ২৫টি আসনের মধ্যে একমাত্র কমলনাথের পুত্রই জয়ী হয়েছেন। রাহুলের অভিযোগ, এই দুই মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ছেলেদের জন্যই ব্যস্ত ছিলেন, দলকে বাঁচাতে নয়। তাই বিজেপি হয়তো এই লেখা বের হওয়ার আগেই এই দুই রাজ্যের সরকারকে সরিয়ে দেবে। কলকাতা থেকে ভূপালে কমলনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কমলনাথ সরাসরি অভিযোগ করেন কংগ্রেসের প্রত্যেক বিধায়ককে ৫০ কোটি টাকা করে বিজেপি প্রস্তাব দিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে তিনি সেই নামগুলো প্রকাশ্যে আনবেন। তিনি আরো বলেন যে প্রয়োজনে আমি আস্থা ভোট নেব। জন্মসূত্রে কমলনাথ কলকাতার বাসিন্দা। উত্তর প্রদেশে রায়বেরিলি কেন্দ্র থেকে রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধী জিতেছেন। নেহরুর আমলে কংগ্রেস সভাপতি হতেন দক্ষিণের কোনো রাজ্য থেকে। সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা একসময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দক্ষিণ ভারত থেকে পাঁচজন কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন আসামের দেবকান্ত বড়ুয়া। নরসিমা রাওয়ের সময়ও কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন বিহারের সীতারাম কেশরী। কিন্তু ১৯৯১ সালের মে মাসে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতারা দিল্লির ১০ নম্বর জনপথে গিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলেন কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য; কিন্তু সোনিয়া গান্ধী সে কথায় কর্ণপাত না করে আট বছর নিজের ছেলে-মেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে।

সব রাজনৈতিক দলেরই একটা ভিন্ন আদর্শ থাকে। কংগ্রেসের আদর্শ হলো ভারতের সংবিধান মেনে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা কংগ্রেসের আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হলে ভারতবর্ষ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বেই আবার ফিরে আসার আশঙ্কা করছেন। ভারতবর্ষ একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সবার সমান অধিকার। এই অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হলে ভারতবর্ষের মূল কাঠামোর ওপর প্রচণ্ড আঘাত আসার আশঙ্কা কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী তথা ইতিহাসবিদ ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—বর্তমান ভারতে যদি ‘হেজিমোনিক’ প্রকল্প থাকে, তা হলো একটিই—হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ববাদ ভারতীয় চেতনায় যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, অন্য কোনো ধারণা এ মুহূর্তে সেই রকম ভূমিকায় নেই। সপ্তদশ নির্বাচনের ফলাফল বিচার চলছে—আরো কিছুকাল চলবে। ইতিহাসবিদের এই উক্তি সেই ফল বিচারের ওপর এক বিশেষ সন্ধানী আলো ফেলতে পারে। শুধু ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই নন, দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিজেপির একটা লক্ষণ দেখে যারপরনাই চিন্তিত। ভারতের মতো দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আলাদা আলাদা আদর্শ আছে। যেমন—কংগ্রেসের একটি আদর্শ আছে। তা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজেপির আদর্শ হলো হিন্দুত্ববাদ। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো কোনো আঞ্চলিক দল নীতি ও আদর্শহীনভাবে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। আর মাওবাদী দল চাইছে বিপ্লব। একুশের দশকে ভারতবর্ষের মতো দেশে সশস্ত্র বিপ্লব করা যে সম্ভব নয়, সেটা তারা বুঝতে পারছে না। তারা তাই সন্ত্রাসবাদী কায়দায় একটার পর একটা সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। কিন্তু সন্ত্রাস দিয়ে কি বিপ্লব হয়?

ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী আঞ্চলিক দলগুলো। যেমন—উত্তর প্রদেশের মায়াবতী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—দুজনেই এবার প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন। আর এই দুজনকে উসকে ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং মুম্বাইয়ের কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী। নির্বাচনের ফল প্রচারের ২৪ ঘণ্টা আগে মায়াবতী এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করলেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, আর কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৃণমূল গঠন করার দিন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করতে থাকেন, তিনি ইন্দিরা গান্ধীর থেকেও বড় মাপের নেত্রী। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তাঁর আছে। তিনি নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন—পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে তিনি ৪২টিই পাবেন। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়া তাঁর পক্ষে খুবই সহজ। নির্বাচনের পরপরই চার-পাঁচজন তৃণমূল বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি এই যোগ দেওয়ার জন্য রুষ্ট হলেও তাঁর একদা ঘনিষ্ঠ মুকুল রায়, যিনি তৃণমূলে থাকাকালীন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কিনে দল ভারী করেছিলেন। একেই বলে ধর্মের কল। তাদের এই চাপান-উতোরের মধ্যে মুকুল রায় বলেছেন, বিধানসভায় তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন কংগ্রেস ও বামপন্থীদের থেকে ২৫ জন বিধায়ককে কিনে নিলেন। যত দিন যাবে, ততই এই কেনাবেচা চলবে। বিজেপি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে ২০২১ সালের আগেই তৃণমূল সাফ হয়ে যাবে।

রাহুল গান্ধী যাতে কংগ্রেস সভাপতির পদ না ছাড়েন, সে জন্য সারা দেশের কংগ্রেস নেতারা তাঁকে অনুরোধ করে দিল্লিতে গিয়ে ধরনা দিতে শুরু করেছেন। রাহুল কিন্তু তাঁর আদর্শ ও সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরতে নারাজি। তবে রাহুল নিজে চাইছেন সংসদে লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা হতে। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সভাপতি সোমেন মিত্র বলেন, রাহুলই একমাত্র নেতা, যিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন, না হলে দলের ভাঙন আটকানো যাবে না। দলকে এক এবং ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে রাহুলকে দলের সভাপতি চাই-ই চাই। এমনকি দক্ষিণের আঞ্চলিক নেতারাও সংবাদমাধ্যমকে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, রাহুল পারবেন ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে। তাঁর আদর্শ ও নীতি আছে। সব মিলিয়ে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ভয়ংকর সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ—এই লড়াইয়ের যে কবে অবসান হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। রাজনীতিবিদরাও এ ব্যাপারে হতাশাগ্রস্ত।

লেখক : কলকাতার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877