দেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট গ্রুপ। এসব সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে কাজী ও সিপিসহ ১০ কোম্পানি ও সংগঠন। ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাজী ফার্মসহ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয় তা অমান্য করে চলেছে সিন্ডিকেটের এ ১০ প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে কাজী ফার্ম এর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে বাজারে যখন ডিমের দাম বৃদ্ধি পায় তখন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহিন বিদেশে অবস্থান করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পর্যায়ে যখন খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক হয় তখন কাজী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ বিদেশে বসে তিনি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রধান উৎস এ দুই পণ্যের বাজারে অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর। নানামুখী সঙ্কটেও ডিম ও মুরগিসহ পোলট্রি পণ্যের ব্যবসায় ভালো মুনাফা করছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে এ খাতের অন্যতম শীর্ষ তিন কোম্পানি কাজী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রির মোট সংরক্ষিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতি মুনাফার দায়ে সাম্প্রতিক দেশের ১০টি পোলট্রি ফার্ম ও পোলট্রি সংশ্লিষ্ট সংগঠনের বিরুদ্ধে ডিমের দাম বৃদ্ধিতে বাজারে কারসাজির অভিযোগে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে এবং প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এর অধীনে এই আইনে আদালতে না গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ আছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন ডিমের বাজারে অস্থিরতার জন্য কাজী ফার্মস, সিপি, প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড, পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, নাবা ফার্ম লিমিটেড, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পোলট্রি ফার্ম প্রোটেকশন ন্যাশনাল কাউন্সিল, পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্ট সরাসরি জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, বড় দশটি কোম্পানি বাজারে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করছে। এসব কোম্পানি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে ডিম বিক্রি করছে। তিনি বলেন, সরকার লেয়ার ডিওসি মূল্য ৫৭ টাকা নির্ধারণ করলেও কোম্পানিগুলো ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। লেয়ার মুরগির জন্য ফিডের দাম প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করলেও এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, করপোরেট গ্রুপ ও বিভিন্ন ডিম সমিতি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যখন যা চায়, তাই হয়। এই করপোরেট ও সমিতিগুলোর কারণে সাধারণ খামারিরা বিপদে পড়েন। তিনি বলেন, সরকার খামারিদের সঙ্গে আলোচনা না করে ওদের সঙ্গে বৈঠক করে। এতে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী ডিমের পর্যাপ্ত উৎপাদন আছে। তার পরও দাম বাড়ার কারণ জানি না।
এ দিকে সাধারণ খামারিরা অভিযোগ করেন, ডিম ৪০ শতাংশ এককভাবে সরবরাহ করে কাজী ফার্মস গ্রুপ। বাদ বাকি অন্য সব প্রতিষ্ঠান মিলে সরবরাহ করে ৬০ শতাংশ ডিম। দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেটের মাস্টার মাইন্ড কাজী ফার্মস গ্রুপের কাজী জাহিদুল হাসান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন কাজী ফার্ম ডিমের দাম বাড়ানোর জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মুরগির বাচ্চা সরবরাহের ক্ষেত্রে কাজী ফার্ম একক ভাবে ৮০ শতাংশ মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে। তারা নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করে দেয়। এ দিকে মুরগির খাবার সরবরাহ এবং প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্ম। অন্যদের সাথে সমন্বয় করে প্রতিষ্ঠানটি দাম বৃদ্ধি করে থাকে। একই সাথে চুক্তিভিত্তিক ফার্মিং-এর মাধ্যমে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক লাভবান হতে পারে না। কারণ, মুরগির খাবার, বাচ্চার দাম বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয় কাজী ফার্ম।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন করপোরেট সিন্ডিকেটের কারণে ডিমের দাম বাড়ছে। বাজারে ৮০ শতাংশ ডিম সরবরাহ করে খামারিরা। ২০ শতাংশ সরবরাহ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ করপোরেট গ্রুপ ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থির করে তোলে। তারা আরো বলেন, খামারিদের সঙ্গে সরকার কথা বলে না। বৈঠক করে করপোরেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। অন্য দিকে আড়তদাররা বলছেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। ফলে তারা ডিম বিক্রি বন্ধ রাখছেন।
দেশে মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি খাদ্যের (ফিড) সিংহভাগ উৎপাদন করছে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি। পাশাপাশি ডিম ও গোশতের বাজারেরও বড় অংশ তাদের দখলে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি চুক্তির ভিত্তিতে কোম্পানির বাইরে অন্য অনেক খামারিকেও কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। বাজারের আকৃতি, মুনাফাসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের বিষয়ে কোম্পানিগুলো বরাবরই এক ধরনের গোপনীয়তা বজায় রাখে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি) সদস্য সোলমা আখতার জাহান বলেন, কারসাজি চক্রের দাম বাড়ানোর ঘটনা মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে চিহ্নিত করা হয়। বিসিসির অনুসন্ধানী দল বাজার থেকে তথ্যসংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতা পেলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সাম্প্রতিক তদন্তে এসেছে, বেশ কয়েকটি কোম্পানি ও তাদের সংশ্লিষ্ট সমিতি যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি মুনাফা করেছে। অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ থাকায় মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ডিমের বাজারে অস্থিরতার কারণে সিপি, প্যারাগন, কাজী, ডায়মন্ড এগ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: আমানত উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিসিসি। সেই মামলা এখনো চলমান বলে তিনি জানান।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগে গত বছর প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ কয়েকটি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে ও দোষীদের শাস্তি না হলে হঠাৎ যে কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এতে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
এ দিকে ডিমের দাম কমাতে বাজারে অভিযানে নেমেছে সরকার। কিন্তু তাতে দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু কিছু পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ অথবা কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বরং সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
ঢাকার বাজারে গতকাল ব্রয়লার মুরগির বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে প্রতি ডজন (১২টি) ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ৮ আগস্ট ডিমের দাম ছিল ডজনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬২ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ডিমের বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার। সেটা করা যেতে পারে সরবরাহ বাড়িয়ে। সরবরাহ কম থাকলে বাজারে কারসাজি করার সুযোগ তৈরি হয়। তখন অভিযান চালিয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না।
কৃষি বিপণন অধিদফতর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রয়লার মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেয়া দাম অনুসারে, উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের মূল্য ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে তা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হয় ১৪২ টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদফতর জানিয়েছে, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য পোলট্রি খাতের অনেকে বলছেন, দাম নির্ধারণ করতে হলে উৎপাদন খরচ নিয়ে গবেষণা দরকার।
এ দিকে নির্ধারিত দর বাস্তবায়ন করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে। মূলত অভিযানের ভয়েই ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে ডিমের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ বলেন, নির্ধারিত দামে কিনতে পারলে নির্ধারিত দরে বিক্রি করা যায়। বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন কিছু আড়তে কেনাবেচা বন্ধ থাকলেও বিকল্পভাবে ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে। যদিও দাম চড়া। এ দিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ সঙ্কট বড় কারণ। দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আগে দিনে সাড়ে চার-পাঁচ কোটির মতো ডিম উৎপাদন হতো। এখন তিন কোটির বেশি উৎপাদন নেই। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।
এ দিকে খামার মালিকরা বলছেন বাড়তি চাহিদা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি সরবরাহ কম। এর কারণ গরম, লোডশেডিং ও বন্যায় মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া পোলট্রি খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ এবং মুরগির বাচ্চার উচ্চ দামের কারণে খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
কাজী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহিন-এর বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করার কথা বলেন। তার ইমেলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।