নাগিব বাহার: ১১ই অক্টোবর ‘ব্যক্তিগত বাংলা লাইব্রেরি বিক্রি হবে’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় একটি দৈনিক পত্রিকায়। এক ব্যক্তি প্রায় ৫০ বছর ধরে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বই এবং পত্রিকার সংগ্রহ বিক্রি করার ঘোষণা দেন সেখানে। ১৯৭০ সাল থেকে বাংলা বই সংগ্রহ করে চলেছেন বর্তমানে অবসারে যাওয়া স্কুল শিক্ষক গোকুল চন্দ্র দাস। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার একটি সরকারি স্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে।
ছাত্রজীবনে এবং পেশাগত জীবনে লাইব্রেরি রক্ষণা-বেক্ষণে তেমন সমস্যা না হলেও ২০১৪ সালে অবসর নেয়ার পর থেকেই লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। ষাটোর্ধ্ব এই সংগ্রাহক তার সারাজীবনের সংগ্রহ বিক্রি করে দিতে চাইছেন রক্ষণা-বেক্ষন খরচ সামলাতে পারছেন না বলে। সেখানে তিনি ‘বিনিময় মূল্য’ ধরেছেন লাইব্রেরির জন্য ১৫ লাখ টাকা এবং পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য ১০ লাখ টাকা। এই সংগ্রহশালা গড়ে তোলার পেছনের গল্প নিয়ে কথা হয় তার।
‘কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা যেই লাইব্রেরির’: ১৯৭০ সালে দশম শ্রেণিতে থাকার সময় প্রথম বই কেনা করা শুরু করেন মি. দাস। “সেসময় কিছু কিছু কবিতা লিখতাম। তখন সুযোগ পেলে বিখ্যাত কবিদের কবিতার বই কিনতাম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। সেগুলো সংগ্রহ করতে করতে লাইব্রেরি বানানোর বিষয়টি প্রথম মাথায় আসে বলে জানান তিনি। বই কেনার ক্ষেত্রে তার প্রাথমিক পছন্দ ছিল কবিতার বই। পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংগ্রহ করেন আত্মজীবনীমূলক এবং গবেষণাধর্মী বইও। এছাড়াও বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন ধরণের বই রয়েছে তার কাছে। “ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গবেষকের পিএইচডি থিসিস রয়েছে আমার সংগ্রহে। বানান, বাগধারা, ইতিহাস, ভূগোলের মত নানান বিষয়ের দেড় শতাধিক অভিধানও রয়েছে।”
পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা: বিভিন্ন ধরণের বাংলা বই ছাড়াও বাংলাদেশে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা সংগ্রহ করছেন তিনি গত ৪৭ বছর ধরে। “১৯৭২ সাল থেকে পত্রিকা সংগ্রহ শুরু করি আমি। সেবছর যখন খেয়াল করি যে বিশেষ দিনে-যেমন ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বর – মূল পত্রিকার সাথে আলাদা একটি অংশ দেয়া হয় যেগুলোতে বিভিন্ন কবি এবং লেখকদের নানারকম লেখা থাকে।” “সেসময় আমার মনে হয়-যদি পত্রিকা সংগ্রহ করা শুরু করি, তাহলে একদিন হয়তো আমার সংগ্রহে অনেক লেখকের কবিতা বা রচনা থাকবে। সেই চিন্তা থেকেই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা সংগ্রহ করা শুরু করি। কোনো একটি বিশেষ দিবসে যতগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হতো, সেগুলোর প্রত্যেকটির সাথের ক্রোড়পত্র সংগ্রহ করা শুরু করি।” মি. দাস জানান, প্রথম পাঁচ-ছয় বছর বিশেষ দিবসগুলো উপলক্ষ্যে প্রকাশিত পত্রিকার পুরোটাই সংগ্রহে রাখতেন তিনি। কিন্তু পরে শুধু ক্রোড়পত্র বা পত্রিকার সাথে প্রকাশিত বিশেষ অংশটি জমানো শুরু করেন। এমনকি এবছরেও ২৬শে মার্চ ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিশ-একুশটি পত্রিকার সাথের ক্রোড়পত্র সংগ্রহ করেছেন তিনি।
ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত সকল কবিতার সংগ্রহশালা: ক্রোড়পত্রগুলো এখন একটু অন্যভাবে সংরক্ষণ করছেন মি. দাস। সেখানে প্রকাশিত কবিতাগুলো আলাদা করে কেটে সংকলন করেছেন তিনি। মি. দাস বলেন, গত ৪৭ বছরে বিভিন্ন ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত কবিতাগুলো একসাথে সংকলন করে ১৬টি খন্ডে ভাগ করেছেন। “এই ১৬টি খন্ড বই আকারে প্রকাশ করলে বাংলাদেশের পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় যাদের কবিতা ছাপা হয়েছে সেগুলো একসাথে পাওয়া যাবে।” এছাড়াও এই ৪৭ বছরে পত্রিকায় যখনই কোনো সাহিত্যিক বা লেখকের সম্পর্কে কোনো লেখা ছাপা হয়েছে সেগুলোও আলাদা করে রেখেছেন তিনি।
যে কারণে বিক্রি করতে চান শখের লাইব্রেরি: চাকরি থাকাকালীন এই শখের লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব একটা কঠিন না হলেও অবসরের পর লাইব্রেরির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গোকুল চন্দ্র দাসকে। বর্তমানে স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। মি. দাস বলেন, “এমনিতে তিন রুমের একটি বাসা হলেই আমাদের চলে। কিন্তু এই বইগুলো রাখতে হলে একটি আলাদা ঘর প্রয়োজন হয়, যার জন্য বাড়ির ভাড়াও বেড়ে যায়। অবসরের পর বইয়ের জন্য অতিরিক্ত খরচ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।” একারণে ১১ই অক্টোবর লাইব্রেরির বই ও পত্রিকা বিক্রি করে দেয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেন গোকুল চন্দ্র দাস।