রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৫ অপরাহ্ন

টি-শার্টের ক্যানভাসে সৃজনশীল বাংলাদেশ

টি-শার্টের ক্যানভাসে সৃজনশীল বাংলাদেশ

গাজী মুনছুর আজিজ: টি-শার্ট আর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট অনেকটা একই সূত্রে গাঁথা। কারণ, আজিজের টি-শার্ট বলতেই চোখে ভেসে উঠে শিল্প-সংস্কৃতিনির্ভর নকশার টি-শার্ট। আবার দেশীয় নকশার টি-শার্ট মানেই আজিজের টি-শার্ট। তাই টি-শার্ট আর আজিজ মার্কেট পরস্পর পড়শি। এছাড়া দেশীয় নকশার টি-শার্ট কিংবা টি-শার্টের জন্য আজিজ সুুপার মার্কেটের পরিচিতি হওয়ার পেছনে যে প্রতিষ্ঠান পথিকৃৎ সেটিÑ নিত্য উপহার এবং এর কর্ণধার বাহার রহমান। মূলত: নিত্য উপহারের হাত ধরেই এদেশে দেশীয় ঢঙের টি-শার্টের প্রচলন হয়েছে। কিংবা নিত্য উপহারের মাধ্যমেই আজিজ মার্কেট দেশীয় ঘরানার ফ্যাশন বাজার হিসেবে পরিচিত। শুরু থেকেই নিত্য উপহারের টি-শার্টের নকশায় স্থান পেয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি বা ইতিহাস-ঐতিহ্য। সে ধারাবাহিকতা রয়েছে এখনও। আজিজ মার্কেটের তৃতীয় তলার ১৬ নম্বর দোকানে নিত্য উপহারের যাত্রা শুরু ১৯৯৪ সালে। তবে তারা টি-শার্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন ২০০১ সাল থেকে। ৬টি নকশার টি-শার্ট নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। ‘নব আনন্দে জাগো’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘তাদের খাড়া দুটো শিং’ শিরোনামের টি-শার্টগুলো নিত্য উপহারের প্রথম দিককার। এখন পর্যন্ত তাদের প্রায় ১ হাজার ১০০টির বেশি নকশার টি-শার্ট হয়েছে।
নিত্য উপহারের পথ ধরে আজিজ মার্কেটে মেঘের যাত্রা ২০০২ সালে। তিন বন্ধু সাইফুল ইসলাম, বাপ্পাদিত্য চৌধুরী ও অহিদুল ইসলাম মিল্টন মিলে খুলেছেন মেঘ। অবশ্য দুই বছর না যেতেইে মিল্টন ছাড়া অন্যরা মেঘ ছেড়ে চলে যান। শুরুতে মেঘ হ্যান্ডি ক্র্যাফটই বিক্রি করত। বছর খানেক পর তারা টি-শার্ট তৈরি করতে শুরু করে। রূপসী বাংলা, পারাপার, কবি শামসুর রাহমান ছিলেন তাদের প্রথম দিককার টি-শার্টের নকশায়। জাহিদ ক্র্যাফটও এসময়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারপর পর্যায়ক্রমে আজিজ মার্কেটে টি-শার্টের কার্যক্রম শুরু করে কাকতাড়–য়া, দাঁড়কাক, পৌষসহ বিভিন্ন হাউস। এক সময় আজিজ মার্কেট ছিল বইয়ের মার্কেট। ধীরে ধীরে সে মার্কেট এখন প্রায় পুরোটাই ফ্যাশন মার্কেটে রূপ নিয়েছে। খুচরার পাশাপাশি আজিজের প্রায় সব হাউস তাদের পণ্য পাইকারিও বিক্রি করে।
নিত্য উপহারের কর্ণধার বাহার রহমান বলেন, শুরু থেকে আমরা টি-শার্টের নকশায় শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি টি-শার্টে তুলে এনেছি কীর্তিমানদের প্রতিচ্ছবি, ক্রিকেটের ইতিহাস। শিশুদের আঁকা ছবি দিয়েও আমরা টি-শার্ট করেছি। এসব ছবি ‘বসে আঁকো’ শিরোনামে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করেছি। সম্প্রতি আমরা ‘রূপসী বাংলা’ এবং ‘দেখি বাংলার মুখ’ শিরোনামে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের আলোকচিত্র দিয়েও টি-শার্ট করেছি। এসব আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের ‘শ্যামলী নিস্বর্গ’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা বাছাই পর্ব চলছে। এখান থেকে বাছাই আলোকচিত্র দিয়েও টি-শার্ট করা হবে। এছাড়া আমাদের সব নকশাই শিল্পীদের মাধ্যমে নেওয়া। ইন্টারনেট বা অন্য কোনো উপায়ে নেওয়া নয়। সে জন্য আমরা বরাবরই স্বতন্ত্র। কিন্তু অনেক হাউসই এ কাজটা করে না। তারা ইন্টারনেট বা নানাভাবে নকশা সংগ্রহ করে। এক সময় দেশীয় নকশার জন্য যে আজিজ মার্কেট ফ্যাশনপ্রিয়দের কাছে বা তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় ছিল, সেই আজিজ মার্কেটে এখন দেশীয় ঢঙের টি-শার্ট একটু কম হয় বলে মনে করি।
মেঘের কর্ণধার অহিদুল ইসলাম মিল্টন বলেন, এক সময় দেশীয় নকশার টি-শার্টের জন্য আজিজ মার্কেটের যে পরিচিতি, সে অবস্থান আগের মতো নেই। নতুন নতুন অনেক হাউস হয়েছে। এসব হাউস দেশীয় নকশার টি-শার্টের চেয়ে পশ্চিমা ঢঙের টি-শার্ট বেশি করছে। অবশ্য এতে তাদের ব্যবসাও ভালো। বাহার রহমান বলেন, পশ্চিমা ঢঙের টি-শার্ট আগেও ছিল, পরেও থাকবে। তবে আমরা যে দেশীয় ঢঙের বাজার তৈরি করেছি সেটি মনে করি আগের মতো নেই। অবশ্য সবাই সব রকম কাজ করবেন এমনটাও নয়। যাদের স্বদেশী চিন্তা আছে তারা স্বদেশী মোটিফেই কাজ করবেন। অন্যরা করবেন তাদের মোটিফে। এটাই নিয়ম। আমরা আমাদের গতিতেই চলছি।
আজিজের টি-শার্টের বাজার আরও গতিময় করতে কয়েক বছর ধরে ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ টি-শার্ট উৎসব। সম্প্রতি আজিজ মার্কেটের ফ্যাশন হাউসগুলো ঘুরে দেখা গেল, আজিজের প্রথম দিককার টি-শার্টের যে ঢঙ সেই টি-শার্ট কমই দেখা গেল। অন্যদিকে ট্যাগ আর লোগো খুলে ফেললে প্রায় সব টি-শার্টই এক হাউসের মনে হবে। অর্থাৎ সবাই ঘুরেফিরে প্রায় কাছাকাছি নকশার টি-শার্টই করছেন। অবশ্য কিছু হাউস বরাবরই ব্যতিক্রমী ছিল ও এখনও আছে। তাদের নকশা বরাবরের মতোই আলাদা।
আজিজ মার্কেটের ফ্যাশন ব্র্যান্ড আর্টিজ্যানের কর্ণধার রাকিব হোসাইন বলেন, আজিজ মার্কেটের ফ্যাশন বাজার যাত্রা করেছিল দেশীয় ঘরানার টি-শার্ট দিয়ে। সেটা এখনও আছে এবং থাকবেও। আবার নতুন নতুন হাউস দেশীয় ঢঙের পাশাপাশি প্রজন্মের চাহিদা বা হাল ফ্যাশনের কথা ভেবে পশ্চিমা ধাচের টি-শার্টও করছে। এখন ক্রেতাই খুঁজে নেবেন তার পছন্দের টি-শার্ট। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, শীত, বসন্ত, বর্ষা, বৈশাখ বা যে কোনো দেশীয় উৎসব-পার্বণেই আজিজ মার্কেটের হাউসগুলো টি-শার্ট বাজারে আনে। আর সংস্কৃতিমনা ফ্যাশনপ্রিয়রা এসব টি-শার্ট খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেন। তবে আগে এ জাতীয় টি-শার্টের সংখ্যা বেশি ছিল, এখন তুলনামূলক সে সংখ্যা কম। তবে কম হোক, বেশি হোক, মানের হোক আর অ-মানের হোক, দেশীয় ঘরনার টি-শার্টের জন্য এখনও আজিজ মার্কেটই ফ্যাশনপ্রিয়দের সেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদ রহমান আজিজ মার্কেটে এসেছেন টি-শার্ট কিনতে। তিনি বলেন, আজিজ মার্কেটে আগে অনেক ভালো দেশীয় ঘরানার নকশার টি-শার্ট পাওয়া যেত। এখন পুরো মার্কেট ঘুরলে মনে হয় বঙ্গবাজার। আর আগের মতো ভালো মানের টি-শার্টও নেই। অবশ্য কয়েকটি হাউস তাদের মান ধরে রেখেছে। আর সে কারণেই এ মার্কেটে মাঝেমধ্যে টি-শার্ট কিনতে আসি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877