বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৮ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কী পেলাম, কী পেলাম না

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কী পেলাম, কী পেলাম না

শিরোনামের প্রশ্নটা আমার নয়। ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, যার সঙ্গে আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যখনই সর্বোচ্চ পর্যায়ে কোনো সফর হয়, তখনই এ প্রশ্ন সামনে আসে। তা পথেঘাটে যেমন, তেমনি পত্রপত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। চার দিনের সফর শেষে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। সফর চলাকালে এবং শেষ হওয়ার পর এবারও এ প্রশ্ন চলছে। এ শিরোনাম সে কারণেই।

 প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সফরের সময় তাঁরা বসে দর-কষাকষি করেন না। সে কাজটি তাঁদের অধস্তন কর্মকর্তারা সফর শুরুর আগেই সেরে রাখেন, তাঁদের পূর্বানুমতি নিয়েই। সফরের সময় দুই নেতা মুখোমুখি বসে এর আগে সম্মত সেই বিষয়গুলোতে তাঁদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন। সফরের তাৎপর্যকে দৃশ্যমান করার জন্য কিছু আনুষ্ঠানিকতারও আয়োজন করা হয়। যেমন জনাব মোদি তাঁর বিগত সফরে দুই দেশের মধ্যে বাস চলাচল উদ্বোধন করেছিলেন।

কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীপর্যায়ে দর-কষাকষির এ পদ্ধতি চলে দীর্ঘদিন ধরে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় থাকলে তার খসড়া বিনিময়, দূতদের যাতায়াত এসব নিয়ে খবর প্রকাশ থেকে জল্পনাকল্পনা চলতে থাকে। ফলে সফর শুরুর আগেই কী হতে যাচ্ছে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়, তার খুঁটিনাটি নিয়ে গোপনীয়তা যদি বজায়ও থাকে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের আগে এ ধরনের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান হয়নি। সফর ঘিরে প্রত্যাশাও তাই পাখা মেলেনি। প্রত্যাশার পারদ বরং কিছুটা চড়িয়ে দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সফর–পূর্ব বক্তব্যে। এ সফরের বড় অংশ জুড়ে ছিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিট। সামিটে অংশগ্রহণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি ডায়ালগ অন বাংলাদেশে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ভারতীয় এবং উপস্থিত অন্য বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। সফরের দ্বিপক্ষীয় অংশ ছিল শুধু ৫ অক্টোবর।

কিছু সমঝোতা স্মারক সই হবে এটা জানা গিয়েছিল আগেই, তবে তার সংখ্যা আট হবে না আঠারো, তা নিয়ে মতভেদ ছিল। অবশেষে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর বাইরে যে দুটো বিষয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল তা হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারত কতটা সাহায্য করবে, আর আসামের নাগরিক তালিকা নিয়ে উদ্বেগ।

সাতটির মধ্যে তিনটি চুক্তি বাংলাদেশের মানুষের নজর কেড়েছে এক. বাংলাদেশ থেকে উত্তর–পূর্ব ভারতে এলপিজি রপ্তানি, দুই. চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর, তিন. ত্রিপুরার সাবরুম শহরের জন্য ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার। বাংলাদেশে ব্যবহৃত এলপিজির বড় অংশ আমদানি করা, ব্যবসায়ীরা আমদানি করে তা বাজারজাত করেন। তাঁরা যদি এলপিজি আমদানি করে তার কিছু উত্তর–পূর্ব ভারতে রপ্তানি করে কিছু লাভ করেন, তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই হয়েছে। এ সুযোগ কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তার জন্য এই স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের প্রয়োজন ছিল। ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের যে চুক্তি তার পরিমাণ খুব বেশি নয়, এ পানি সীমান্তবর্তী সাবরুম শহরের মানুষের পানীয় পানির চাহিদা মেটাবে।

আপাতদৃষ্টিতে তিনটি বিষয়ের কোনোটাই খুব বড় কিছু নয়। তবে সমস্যাটা অন্যখানে। পরিমাণ যা–ই হোক, তিনটি বিষয়েই ভারতের স্বার্থ জড়িত। মানুষের যা চোখে পড়ছে তা হলো, যেসব বিষয়ে ভারতের স্বার্থ আছে অগ্রগতি হচ্ছে শুধু সেগুলোতেই, বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে কোনো অগ্রগতি নেই। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি। তিস্তা তো বাদ পড়ে গেছে সেই কবেই, সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ছোট ছোট কয়েকটি নদীর বিষয়ে একটি রূপরেখা চুক্তি, তারও কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। মাঝখানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো এই ফেনী চুক্তি। ঠিক এ সময়ে এ রকম একটা চুক্তি কেন করতে হবে, তা আমার কাছে এক বিস্ময়।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারত সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে আবার। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বিষয়টি উঠেছিল। সমর্থন করে পক্ষে ভোট দিয়েছে ৩৭টি দেশ। চীন যথারীতি বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। ভারতের এই ভোট এবং আশ্বাস তার দুই বছরের পুরোনো অবস্থানেরই পুনরাবৃত্তি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাই ভারতের পক্ষ থেকে কোনো প্রকৃত সহায়তা আশা না করাই যুক্তিযুক্ত।

আসামের নাগরিক তালিকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নিজে আশ্বাস দিয়েছেন, অতএব তিনি এটা নিয়ে অন্য কিছু ভাববেন না। ভারতের মতো রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী যদি কিছু বলেন, তাতে তো আস্থা রাখাই স্বাভাবিক। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও আশ্বস্ত করেছেন যে এটা তাঁদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। এই আশ্বাস আমরা শুরু থেকেই শুনে আসছি। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদি বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যা–ই বলুন না কেন, বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছে বলে মনে হয় না। জনাব মোদি এবং তাঁর পূর্বসূরি দুজনেই তিস্তার ব্যাপারে খুব শক্ত আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে আশ্বাসে কোনো ফলোদয় হয়নি। এর বিপরীতে নাগরিক তালিকা নিয়ে ভারতের নেতাদের পক্ষ থেকে বরং আগাগোড়াই বিপরীতমুখী বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি থেকে শুরু করে রাজ্যের নেতারা স্পষ্টভাবে বারবার বলেই চলেছেন যে এই ‘বিদেশি’রা বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী এবং এঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এ বক্তব্য প্রদানকালে ভাষা ব্যবহারে অনেক সময় তাঁরা শালীনতার সীমা অতিক্রম করতেও দ্বিধা করেননি।

এ সফরটার কী প্রয়োজন ছিল তাহলে—গতকাল থেকে এ প্রশ্ন অনেকবার শুনতে হয়েছে আমাকে। আমি বলেছি, এর উত্তর আমি জানি না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877