স্বদেশ ডেস্ক:
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্দান নদীর মাঝে অবস্থিত। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। আল কুদুস, নাবলুস, গাজা, আসকালান ফিলিস্তিনের অন্যতম শহর।
ফিলিস্তিনের ভূমি অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী-রাসূলের কবর রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণস্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামী সংস্কৃতির চারণভূমি। মুসলমানদের এ পবিত্র ভূমি এখন ইহুদিদের করাল গ্রাসে আক্রান্ত।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার অন্যায়ভাবে মুসলমানদের পুণ্যভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়নবাদী ইহুদিদের অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র ‘মসজিদুল আকসা’ দখল করে। এর পর থেকে মুসলমানদের প্রতি ইহুদিদের জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে, যা আজো চলছে।
মনে রাখতে হবে; ফিলিস্তিন আরব ভূমি এবং মুসলমানদের প্রাচীন ভূমি। এখানে ইহুদিদের যে অধিকারের কথা বলা হয়, তার ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। কারণ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেড় হাজার বছর আগেই আরব মুসলমানরা এই অঞ্চল আবাদ করেছিল। ইহুদি এবং তাদের সহযোগীদের চেঁচামেচির ভিত্তি শুধু এতটুকুই যে, ফিলিস্তিনের ছোট্ট একটা অংশে তারা কিছুকাল রাজত্ব করেছিল। ১৮০০ সাল পর্যন্ত ইহুদিদের এই ভূখণ্ডের সাথে রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কোনো ধরনের নেতৃত্ব সম্পর্ক ছিল না। ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণের আলোকে আল আকসা ও জেরুসালেম সব আইনের ভিত্তিতেই শুধু মুসলমানদের; অন্য কারো নয়।
অথচ উড়ে এসে জুড়ে বসা দখলদার ইহুদি গোষ্ঠী এখন পুরো ফিলিস্তিন নিজেদের দাবি করে দখল করতে চাইছে। ১৯৪৮ থেকে জায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিন দখলের নামে অবিরাম মানুষ হত্যা করে চলছে। নারী শিশু সামরিক বেসামরিক জনগণকে পাখির মতো বোম্বিং করে মারছে। কথিত সভ্য পৃথিবী মানুষ মারার রক্তের এই হলিখেলা উপভোগ করছে। ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসলীলা আজ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র মধ্যপাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়া, বাহরাইনসহ গোটা আরববিশ্বে মুসলিম দেশগুলোয় জায়নবাদী আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। জায়নবাদী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে কোনো কোনো মুসলিম শাসক পতিত হয়েছে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মসজিদে আকসা এবং সমগ্র ফিলিস্তিনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অনেক। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে ফিলিস্তিনের অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এই ভূমিকে আল্লাহ পাক বরকতময় ভূমি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা ভ্রমণ করিয়েছেন, যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১)
মক্কা ও মদিনার পর মুসলমানদের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম শহর আল কুদুস। এর পবিত্রতা শ্রেষ্ঠত্ব ও আবেগের মূলে রয়েছে মসজিদে আকসা। ইসলামের দৃষ্টিতে মসজিদে আকসা তৃতীয় শ্রেষ্ঠ বরকতপূর্ণ মসজিদ। এই মসজিদের সাথে মিশে আছে আমাদের নবীজি সা:-এর মেরাজের স্মৃতি। পবিত্র কাবা শরিফের পর পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ এটি।
হজরত আবু জর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। অতঃপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের ব্যবধান। (সহিহ বুখারি : ৩১১৫)
এই মসজিদটি ইসলামের প্রথম কেবলা। রাসূল সা: মদিনায় হিজরতের পর ১৬-১৭ মাস মসজিদে আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেছেন। এরপর আল্লাহ পাকের আদেশে কাবা পরিবর্তন হয়ে বায়তল্লার দিকে কেবলা নির্ধারণ হয়েছে। সে হিসেবে বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। এখনো এই মসজিদে সালাত পড়ার অসংখ্য সওয়াব রয়েছে।
হজরত আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মসজিদে হারামে এক রাকাত সালাত এক লাখ সালাতের সমান। আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক রাকাত সালাত এক হাজার রাকাত সালাতের সমান এবং বাইতুল মাকদাসে এক রাকাত সালাত পাঁচ শ’ রাকাত সালাতের সমান। (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ৪/১১)
তা ছাড়া মুকাদ্দাসে যারা সালাত আদায় করবে তাদের জন্য এই মসজিদের নির্মাতা হজরত সুলাইমান আ: বিশেষ দোয়া করে গেছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি এই মসজিদে নামাজের উদ্দেশ্যে আগমন করবে, তুমি তাকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ করে দিয়ো, যেদিন সে দুনিয়াতে এসেছিল। (সুনানে ইবনু মাজাহ : ১৪৭৯)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা মসজিদে আকসায় যাও, সেখানে গিয়ে সালাত আদায় করো। কেননা, তাতে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা অন্যান্য মসজিদে এক হাজার সালাত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। আর যে ব্যক্তি মসজিদে আকসায় যাওয়ার শক্তি-সামর্থ্য রাখে না, সে যেন তাতে দীপ জ্বালানোর জন্য তেল হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে। কেননা যে বায়তুল মাকদিসের জন্য হাদিয়া প্রেরণ করে, সে তাতে সালাত আদায়কারী ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে। (মুসনাদে আহমাদ : ২৬৩৪৩ সুনানে আবু দাউদ-৪৫৭)
ফিলিস্তিন আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমি : রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘ইসলামী বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা রা: জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি সে যুগ পাই, তখন আমি কোন দলটিতে যোগদান করব, তা বলে দিন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে, কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি, সেখানে তিনি তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট বান্দাদের একত্র করবেন। আর যদি তুমি তাতে যোগদান না করো, তাহলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো, আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ-২৪৮৩)
জায়নবাদী ইহুদিদের এই জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে। সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে আল কুদসের মুক্তি এবং স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ।
আকসা ফিলিস্তিন আমাদের, আকসা মুসলমানদের, আকসা আমাদের হবে ইনশাআল্লাহ। আকসার সংরক্ষণ ও এর পবিত্রতা রক্ষা করা শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়; বরং সব মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা বারবার বলেছেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি দখলদার জালিম ইসরাইলের এ জুলুমের অবসান একদিন হবে। আল-আকসাকে ঘিরে আবার জেগে উঠবে নিরাপদ প্রাণের স্পন্দন। অসংখ্য নবী-রাসূলের পদধন্য এ ভূমি আবার আনন্দে হাসবে।
লেখক :
সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ যাকারিয়া ঢাকা, কাঁচকুড়া উত্তরখান ঢাকা